জানেন, এই যে হাজার বছর ধরে পৃথিবী জুড়ে পা রাখা কোটি কোটি মানুষ; তাদের কত রকম রং-ঢং, চোখ-চুল-আকার; তবু মানুষে মানুষে ডিএনএতে মিল রয়েছে একদম শতকরা ৯৯.৯ ভাগ। শিম্পাঞ্জির সাথেই আমাদের ডিএনএ মিলে যায় ৯৯ ভাগ! এমনকি কেঁচোকৃমির সাথেই আমাদের ডিএনএ মেলে ২১ ভাগ!
ডিএনএ টা কী? কেনই বা মানুষে মানুষে ডিএনএ তে এত্ত মিল? আর এই যে মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ পার্থক্য,আপনার আমার ডিএনএ তে, তাতেই কেমন করে লুকিয়ে আছে এত তথ্য যে আমরা একে অপর থেকে হয়ে উঠেছি এতটাই স্বতন্ত্র্য?
আসলে ট্রিলিওন ট্রিলিওন কোষ দিয়ে তৈরি আমাদের শরীর। আর প্রতিটি কোষ জুড়েই রয়েছে জট পাকানো সূতার বান্ডিলের মতো দেখতে ডিএনএ। আর এই ডিএনএ তেই সাজানো আছে আমাদের নানা বৈশিষ্ট্যের জন্য নির্দেশনা। একদম হাতে গোণা অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া-ছত্রাক থেকে শুরু করে সব উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবনের নির্দেশনা থাকে ডিএনএ তে। ডিএনএ ই আমাদের সন্তানের দেহে বয়ে নিয়ে যায় আমাদের বৈশিষ্ট্য। এভাবেই আপনার পূর্বপুরুষ থেকে আপনি পেয়েছেন যে দেহের গড়ন, ভঙ্গি, স্বভাব, এমনকি অসুখবিসুখও; ডিএনএ সেগুলো বয়ে নিয়ে যায় আপনার সন্তান হয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আর একেই বলা হয় বংশগতি।
কেমন করে বংশগতি হয়, অর্থাৎ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কেমন করে আমাদের বৈশিষ্ট্য প্রবাহিত হয়, এই উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানী গ্রেগর জোহান মেন্ডেল গীর্জার বাগানে মটরশুঁটি চাষ করতে শুরু করেছিলেন। নানান রকমের মটরশুটির গাছের মধ্যে শংকর তৈরি করে করে তিনি বাবা-মা গাছের মটরশুঁটির সাথে সন্তান গাছের মটরশুঁটির তুলনা করে কিছু সিদ্ধান্তে আসেন। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের ফলেই জানা গিয়েছিল জীবজগতে বংশগতি কেমন করে হয়।
আমাদের অনেক বৈশিষ্ট্যই আসলে দুটি জিনিসের সমন্বয় থেকে আসে। এই দুটো জিনিসের একটি আসে মা থেকে, একটি বাবা থেকে। মেন্ডেলের সূত্র আবিষ্কারের বেশ কিছু সময় পরে বিজ্ঞানীরা এ দুটো জিনিসের নাম দেন এলিল (Allele). এলিল হল একই জিনের (Gene) এর ভিন্ন ভিন্ন রূপ যা আমরা আমাদের মা-বাবার কাছ থেকে পাই। এরকম হাজারো জিনের হাজার বছর জুড়ে চলে আসা মিথস্ক্রিয়াই নির্ধারণ করেছে ‘আমরা কেমন করে এমন হলাম’! এ জিনগুলো শরীরের কোথায় থাকে বলুন ত? সেই যে, শুরুতেই ডিএনএ র কথা বলেছিলাম? ডিএনএ তে থরে থরে সাজানো থাকে জিনগুলো। তবে, ডিএনএ র সবটুকুই কিন্তু জিন নয়! জিন ছাড়াও ডিএনএ তে সাজানো আছে বেঁচে থাকার জন্য আরো নানা উপাদান। তবে সে গল্প আমরা আরেকদিন করব।
ধরা যাক, আপনার গায়ের রঙ তৈরির নির্দেশ দেয় একটি জিন আর ওই জিনের আছে দুটো এলিল, একটি পেয়েছেন আপনার মায়ের কাছ থেকে, একটি বাবার কাছ থেকে। এই দুটো এলিল বোঝাপরা করে ঠিক করবে আপনার গায়ের রঙটা কেমন হবে।
কালো আর বাদামী, এ দু রঙের লোমের গিনিপিগের গল্প বলি। মনে করুন, লোমের কালো রঙ আসে এলিল ‘ক’ থেকে, আর বাদামি রঙ ‘ব’ থেকে। স্বাভাবিকভাবেই বাবা গিনিপিগ, মা গিনিপিগ, দাদা-দাদী-নানা-নানী আর বাবু গিনিপিগ সবারই আছে গায়ের রঙের জন্য দুটো করে এলিল, অর্থাৎ একই জিনের দুটো ভিন্ন রূপ।
যদি মা গিনিপিগের এলিল দুটোও ক,ব হয় (একটি নানী, একটি নানা থেকে পাওয়া),
আর বাবা গিনিপিগের এলিল দুটো ক,ব হয় (একটি দাদী, একটি দাদা থেকে পাওয়া),
বলুন দেখি বাবু গিনিপিগেরা দেখতে কেমন হবে? কালো? না বাদামী?
আর বাবা-মা দুজনেই বা দেখতে কেমন ছিল?

প্রতিটি বাবু গিনিপিগ মা থেকে যে কোন একটি এলিল পাবে, বাবা থেকে যে কোন একটি এলিল পাবে। এভাবে প্রতিটি গিনিপিগের জন্মের সময় লোমের রঙের এলিলে চারটি সম্ভাবনা তৈরি হয়। (পাশাপাশি পর্দার ছকে এলিল দেখানো হবে)
মা (ক,ব) থেকে পাওয়া ক, বাবা (ক,ব) থেকে পাওয়া ক মিলে বাবুর এলিল হতে পারেঃ ক, ক
মা (ক,ব) থেকে পাওয়া ক, বাবা (ক,ব) থেকে পাওয়া ব মিলে বাবুর এলিল হতে পারেঃ ক, ব
মা (ক,ব) থেকে পাওয়া ব, বাবা (ক,ব) থেকে পাওয়া ক মিলে বাবুর এলিল হতে পারে আবারোঃ ক, ব
মা (ক,ব) থেকে পাওয়া ব, বাবা (ক,ব) থেকে পাওয়া ব মিলে বাবুর এলিল হতে পারেঃ ব, ব
ক,ব এলিলের মা-বাবা দুজনেই কিন্তু কালো, ওদের ডিএনএ তে বাদামী এলিল থাকা স্বত্বেও। লোমের রং হোক, উচ্চতা হোক বা অন্য যে কোন বৈশিষ্ট্য, এলিলের মিথস্ক্রিয়ার কিন্তু একটা ফর্মুলা আছে। এই ফর্মুলাই ঠিক করে কোন এলিলের সমন্বয় থেকে কেমন বৈশিষ্ট্য উৎপত্তি হবে।
জিনের দুটো এলিলের শক্তি একই রকম থাকে না, ঠিক যেমন এক বনে দুই বাঘ থাকে না। বেশি শক্তির এলিলটা dominant এলিল, কম শক্তিরটা recessive এলিল। দুটো এলিলের মাঝে যখন একটি dominant এলিল উপস্থিত থাকে, তখন সে একাই ঠিক করে নেয় বৈশিষ্ট্য কেমন হবে। ‘ক’ একটি dominant এলিল, তাই ‘ক,ক’, ‘ক,ব’- এই এলিলের গিনিপিগদের সবার থাকবে কালো লোম কারণ ক কালো রঙের নির্দেশক। recessive এলিলকে রাজত্ব করতে হলে কিন্তু দুটো এলিল ই recessive হতে হবে। তাই বাদামী লোমের গিনিপিগ পেতে হলে বাবা ও মা দুজন থেকেই একটি করে ব এলিল লাগবেঃ ব,ব।
লক্ষ্য করে দেখুন ‘ক,ব’ এলিলের একটি বাবু গিনিপিগ কালো লোমের হলেও বাদামি রঙের recessive ব এলিল কিন্তু ওর ডিএনএ তে রয়েই গেছে। কাজেই dominant এলিলের শক্তির জন্য প্রায়ই কালো গিনিপিগ দেখতে পেলেও বংশ পরম্পরায় বাদামি এলিল কিন্তু ঠিকই ডিএনএ তে রয়ে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরেকটি recessive এলিলের সাথে মিলে বাদামী গিনিপিগের জন্ম দিতে পারে। তাই দুটো কাল গিনিপিগের বাদামি ছানা হলে অবাক হওয়ার কিছুটি নেই, মজার না?
এই যে গিনিপিগের গায়ের রঙের গল্পটা বললাম, কেমন একটা জিনের দুটো এলিল মিলে গায়ের রঙ ঠিক করছে; এটা আসলে প্রকৃতির সহজতর উদাহরণের একটি। মানুষের শরীরের ব্যাপার কিন্তু আরেকটু জটিল। আমাদের বেশির ভাগ বৈশিষ্ট্যই এরকম একটি জিন আর তার দুটি এলিলের মতো সরল নয়। এই দেখুন না, আমাদের উচ্চতা নির্ধারণ করে ৬৯৭ টা এলিল মিলে! আবার সব জিনের যে মাত্র দুটো এলিল থাকে, তাও নয়। আমাদের রক্তের ABO গ্রুপ নির্ধারিত হয় তিনটি এলিলের সমন্বয়ে, এলিল A, এলিল B, এলিল O। A আর B, dominant এলিল; O, recessive এলিল। আপনার মা-বাবার কী কী এলিল আছে, আর তা থেকে আপনি কোন দুটো এলিল পেলেন, তা থেকেই নির্ধারিত হবে আপনার রক্তের গরুপঃ

এমনি করে ডিএনএ তে উপস্থিত অসংখ্যা জিন আর অন্যান্য উপাদান মিলে ঠিক করে ‘আমরা কেমন করে এমন হলাম’।
কিছুদিন আগেও অন্তত এটাই পুরোপুরি বিশ্বাস করা হতো। কিন্তু ক্রমশঃ পরিস্কার হয়ে উঠলো যে, জিনকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এমন খেলুড়েও আছে, আর সে হলো ডিএনএ আমাদের যে কোষগুলোর ভিতরে থাকে, তাদের পরিবেশ বা এনভাইরনমেন্ট। আলো, বাতাস, তাপমাত্রা, খাবার-দাবার, ঔষধ, দৈনন্দিন ব্যবহার করা নানা রাসায়নিক পদার্থ, এমনকি আমাদের মানসিক অবস্থাও ডিএনএ কে নিয়ন্ত্রণ ও পরিবর্তন করতে পারে!
ভেবে দেখুন, মায়ের পেটে যখন একটা মাত্র কোষ বৃদ্ধি পেয়ে একটি পরিপূর্ণ শিশু হয়, সে সময় মায়ের পরিবেশ শিশুর স্বাস্থ্যে কত্তখানি প্রভাব রাখতে পারে! আর এই মাত্রই তো জানলাম, আমাদের ডিএনএ র তথ্য কেমন বংশগতির মাধ্যমে প্রবাহিত হয় ভবিষ্যতে। তবে, শত শত বছর ধরে এই পরিবর্তনগুলো আমাদের ডিএনএ তে সঞ্চিত হলে আমরা কতখানি বদলে যেতে পারি? জানতে চোখ রাখুন থিঙ্ক বাংলায়!
