Skip to content

The Music of Protein (প্রোটিন-সঙ্গীত)


জীববিজ্ঞান নিয়ে অনুসন্ধিৎসু লোক মানেই জানেন জীবদেহে প্রোটিন বা আমিষের নানান প্রয়োজনীয়তার কথা। দেহ গঠনে অংশ নেয় ও অভ্যন্তরীণ নানান প্রক্রিয়া-বিক্রিয়া সম্পাদন করে এই প্রোটিনরা। বেঁচে থাকাই দুরুহ যদি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিনগুলোর কোনটি সঠিকভাবে কাজ না করে।

আপনার জিজ্ঞাসু মন নিশ্চয় জানতে চাইছে এই প্রোটিনেরা কিভাবে তৈরি হয়! খুব সহজ। ইট গেঁথে যেমন তৈরি হয় পাকা ঘর; কোষ বা সেল দিয়ে তৈরি হয় জীবদেহ; একইভাবে অ্যামিনো এসিড নামে একধরনের যৌগ সারি সারি যুক্ত হয়ে তৈরি করে প্রোটিন। এ যেন সুতোয় বাঁধা মুক্তার মালা; মুক্তাগুলো হল অ্যামিনো আসিড, পেপটাইড নামের বাঁধনে তৈরি করে প্রোটিন! ধরে নিন, এই মুক্তার মালাটিতে আছে নানা বর্ণের, নানা আকারের, বিভিন্নভাবে উৎপাদিত মুক্তা। জীবদেহের সংগ্রহশালায় আছে মুলত বিশটি ভিন্ন ধরনের অ্যামিনো এসিড, যাদের মাঝে রয়েছে কিছু মিল, আবার কিছু পার্থক্যও। এই বিশ ধরনের অ্যামিনো এসিডের সংগ্রহ থেকে বিভিন্ন অ্যামিনো এসিড, বিভিন্ন সংখ্যায় যুক্ত হয়ে তৈরি করে দেহের সকল কার্যকরী প্রোটিনগুলোকে। ঠিক যেমন, A থেকে Z পর্যন্ত বর্ণমালার বিভিন্ন বর্ণ, বিভিন্ন সংখ্যায় যুক্ত হয়ে তৈরি করে অর্থপূর্ণ বাক্য।

মানবদেহের সবচেয়ে ছোটো প্রোটিনটিতে আছে মাত্র চুয়াল্লিশটি অ্যামিনো এসিড , আর সবচেয়ে বড় প্রোটিনটিতে অ্যামিনো এসিড আছে ৩৪,৩৫০ টি! এতক্ষণে নিশ্চয় ধরে ফেলেছেন যে, অ্যামিনো এসিডগুলোর ধরন-ধারনের উপরই নির্ভর করবে কোনো একটি প্রোটিনের গঠন, আকার, বৈশিষ্ট্য, ও কাজ। বিশটি অ্যামিনো এসিড এর সংক্ষিপ্ত এক-বর্ণিয় নামগুলো এরকমঃ A, C, D, E, F, G, H, I, K, L, M, N, P, Q, R, S, T, V, W, Y. তাহলে আর দেরি কেন! কল্পনার পাখা মেলে তৈরি করে নিন আপনার পছন্দের প্রোটিন! এই মুহূর্তে আমার মাথায় আসছে এরকম কিছুঃ AEHLQWCCNYF……………………।


বলা বাহুল্য, একজন সাধারন লোকের কাছে, বিশেষ করে শিশু, অক্ষর-জ্ঞানহীন, বা একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর কাছে, প্রোটিনের এই মালা বা সিকোয়েন্স কোনো অর্থ বহন করবে না। তবে হ্যাঁ, বিজ্ঞানের ইতিহাসে আমরা দেখি, বিজ্ঞানীদের সবসময়ের প্রয়াস থাকে বিজ্ঞানকে সাধারন মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার। মেধা, মনন, আর হৃদয়, সব উজাড় করে তাঁরা কাজ করেন মানুষের জন্য। এরই পরম্পরা রক্ষা করে বিজ্ঞানীরা এবার প্রোটিনকে রুপ দিলেন বাদ্যযন্ত্রের সুরে! কারো নাগালের বাইরেই রইল না এবার প্রোটিন সিকোয়েন্স, তাইনা?

নিয়ত গবেষণালব্ধ তথ্য পৃথিবীর জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি জন্ম দিচ্ছে বিজ্ঞানের নতুন নতুন শাখার, আর বাড়িয়ে তুলছে শাখাগুলোর গভীরতা ও জটিলতা। শাখাগুলোর অনেকেই আবার পরস্পর সম্পর্কযুক্ত, এবং জন্ম দিচ্ছে ইন্টারডিসিপ্লিনারি শাখার। এইরকম ইন্টারডিসিপ্লিনারি শাখার বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময় চেষ্টা করেছেন, বিজ্ঞানকে কিভাবে আরো আকর্ষণীয় করে, আরো বেশি জনসংখ্যার কাছে পৌঁছে দেয়া যায়। এই যেমন, ভিক্টর ওয়াং নামের দৃষ্টিশক্তিহীন এক গ্রাজুয়েট ছাত্র একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরি করলেন, যা দিয়ে শুধু সুর শুনে আপনি বুঝে ফেলবেন আবহাওয়ার পূর্বাভাসটি (ওবারস্ট টি, ২০০৫)!

যে কালার কোডগুলো দিয়ে আবহাওয়ার মানচিত্র প্রকাশ করা হয়, সে রঙগুলোকে পিয়ানোর আটাশিটি সুনির্দিষ্ট নোটে রুপ দিলেন তিনি। নোটগুলোর কম্পোজিশন শুনেই বুঝে নেয়া যেতো সংশ্লিষ্ট আবহাওয়ার মানচিত্রটি, রোদ উঠবে কিনা, ঝড় আসবে কিনা! আবার যেমন, জাপানিজ জীববিদরা বিখ্যাত মাঙ্গা কমিকের চরিত্রদের নিয়ে তৈরি করলেন এমন একটি কার্ড গেইম, যা খেলে শিশু বা নিতান্ত সাধারণ লোকজনও বুঝে যাবেন ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজির (বিজ্ঞানের যে শাখায় জীবের বৃদ্ধি ও বিকাশ নিয়ে চর্চা করা হয়) প্রাথমিক ধারনাগুলো (সিরানোস্কি ডি, ২০০৫)! এই সাথে, শুরুর দিকের, সেই ১৯৮৩ সালের বায়োকেমিস্টদের সংবুক (songbook) এর কথা না বললেই নয়, গানের কথা ও সুরে যেখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো বিজ্ঞানের নানা বিষয়গুলোকে। কি ভাবছেন, বলুন তো? বিজ্ঞান বিষয়টা ইন্টেরেস্টিং লাগছে বটে!


হ্যাঁ, বলছিলাম প্রোটিনের কথা, আর তাকে সুরে সুরে প্রকাশ করার কথা। এভাবে, সুরের বিভিন্ন উপাদান, যেমন সুরের দৈর্ঘ্য, গতি, আর প্রাবল্যের মাধ্যমে অল্পবয়সেই শিশুদের কাছে পৌঁছে যাবে জীবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অণুসমূহ, যেমন ডিএনএ বা প্রোটিন সিকোয়েন্সের গল্প। অবশ্য শুরুটা হয়েছিলো ডিএনএ সিকোয়েন্সকে সুরে সুরে প্রকাশ করা নিয়ে, যা কিনা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। ডিএনএ সিকোয়েন্স তৈরি হয় মাত্র চারটি ইউনিট এর বিভিন্ন কম্বিনেশনে/সমন্বয়ে, যাদের সংক্ষেপে প্রকাশ করা হয় এভাবেঃ A, T, C, G। অর্থাৎ একটি ডিএনএ সিকোয়েন্স হতে পারে এরকমঃ ATGCGATCAGTCCTAG…… ।

আমরা এখন প্রায় সবাই জানি যে, ডিএনএ হোলো মানবদেহের তথ্যভান্ডার বা ডাটাবেইজ। ডিএনএ র একটি ইউনিটকে একটি নোটে প্রকাশ করে সিকোয়েন্সকে তেমন শ্রুতিমধুর ও অর্থবহ কিছুতে প্রকাশ করা যাচ্ছিল না। তার বদলে, চেষ্টা করা হয়েছিলো পরপর কয়েকটি ইউনিটকে একসাথে ধরে, একই নোট দিয়ে প্রকাশ করতে। যাই হোক, নানা চেষ্টার পর ও ডিএনএ সিকোয়েন্সকে কোনো অর্থবহ মিউজিক কম্পজিশনে রুপ দেয়া যায়নি।


সত্যি বলতে কি, প্রোটিনকে সুর দেয়ার শুরুর দিকের বেশ কিছু প্রয়াস ও দেখেনি সফলতার মুখ। তবে ২০০৭ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার দুই বিজ্ঞানী, রি তাকাহাশি এবং জেফরি মিলার মিলে সম্ভব করলেন অসম্ভবটুকু। কাজটা সহজ ছিলো না। বিশটি অ্যামিনো এসিড  এর জন্য তাঁরা নির্ধারণ করেন বিশটি ভিন্ন ভিন্ন নোট (♪, ♩)। সহজ কথায়, নোট হচ্ছে সুরের একক বা বিল্ডিং ব্লক (এই যেমন, পাকা বাড়ির জন্য ইট)। একটি নোটকে প্রকাশ করা হয় শব্দের দৈর্ঘ্য আর পিচ (শব্দের উঁচু-নীচু) দিয়ে। কিন্তু কিছু নোট এমন ছিলো যে, একটি থেকে আরেকটিতে যাওয়া ঠিক শ্রুতিমধুর শোনাচ্ছিল না, বরং কেমন বেখাপ্পাই লাগছিল।

সংগীতময়তা আনার জন্য তখন নোট থেকে কর্ডের দিকে নজর দেয়া হল। নোটের সাথে কর্ডের পার্থক্য হল, তিন বা ততোথিক নোট একই সময়ে একসাথে বাজানো হলে তাকে বলে কর্ড। কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দুটি অ্যামিনো এসিড  কে তখন প্রকাশ করা হল একই কর্ড দিয়ে, কিন্তু পার্থক্য করা হল একই কর্ডের বিভিন্ন ভার্সন দিয়ে। একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। G যদি একটি কর্ডের নাম হয়, তবে টাইরোসিন নামের অ্যামিনো এসিড  কে প্রকাশ করা হয় G কর্ডের রুট পজিশন দিয়ে, আর G কর্ডেরই ফার্স্ট ইনভারশন দিয়ে প্রকাশ করা হয় ফিনাইলএলানিন নামের অ্যামিনো এসিডকে। এই কৌশল অবলম্বন করে একটি পাইলট প্রজেক্টে প্রথমবারের মত সংগীতের রুপ দেয়া হল মানবদেহের ‘থাইমিডাইলেইট সিনথেইজ এ’ নামের একটি প্রোটিনকে।

মন্দ হয়নি, কিন্তু কিসের যেন কমতি ছিল! ছন্দ! ছন্দ ছাড়া কি সঙ্গীত হয়! প্রোটিন-সঙ্গীতে ছন্দ ঢোকানোর বিষয়টা  একটু কঠিনই ছিল। তার জন্য ব্যবহার করা হোলো প্রোটিনের নির্দেশনা দেয়া ডিএনএ সিকোয়েন্সটিকে। কোন একটি জীবদেহের ডিএনএ একই সাথে  নির্দেশনা দেয় যে ঐ জীবটির গঠন, কাজ, বা প্রতিটি খুঁটিনাটি কেমন হবে। ডিএনএ র নির্দেশনাসমূহ বাস্তবে রুপান্তরিত করতে এগিয়ে আসে যে হেল্পিং হ্যান্ড, তার নামই প্রোটিন। বলা বাহুল্য, এই প্রোটিনের ধরন-ধারন কেমন হবে, সে তথ্যও সঞ্চিত থাকে ডিএনএ তে, A, T, C, G র নানা সমন্বয়ের মাধ্যমে। A, T, C, G র যেকোনো তিনটির সমন্বয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন কোডন। আর এক একটি কোডন নির্দেশ করে প্রোটিন তৈরির এককটি, অর্থাৎ অ্যামিনো এসিডটি কেমন হবে। যেমন ধরুন, ডিএনএ কোডন সিকোয়েন্স এ TAT বা TAC, দুটোই নির্দেশ করে টাইরোসিনকে। আবার TTT বা TTC নির্দেশ করে ফিনাইলএলানিনকে। এভাবে ডিএনএ র চারটি এককের থেকে তিনটি করে নিয়ে নানান সমন্বয়ে উৎপাদিত হয় বিশটি অ্যামিনো এসিড। চলুন ফিরে যাই সুরের কথায়।

এভাবে প্রতিটি অ্যামিনো এসিড  এর পিছনে যে কোডটি দায়ী, তাকে এসাইন করা হোলো চারটি ভিন্ন দৈর্ঘ্যের নোটের যেকোনো  একটিতে। প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী, কিছু কিছু কোডন, তার সতীর্থদের চেয়ে বেশি ঘনঘন/মাত্রায় ব্যবহৃত হয় অ্যামিনো এসিড তৈরির জন্য। এই বহুল ব্যবহৃত কোডনগুলোকে নির্দেশ করা হয়েছে  চারটি ভিন্ন দৈর্ঘ্যের নোটের সবচেয়ে দীর্ঘটিকে দিয়ে। এভাবে কোন কোডন (অর্থাৎ কোনো অ্যামিনো এসিড ) কত কম বা বেশি ব্যবহৃত  হয়, সেটা বোঝা যাবে নোটের স্বল্পতা বা দৈর্ঘ্য দিয়ে।  তাহলে সব মিলিয়ে কি দাঁড়ালো? সুর, তাল, আর ছন্দ মিলে তৈরি হয়ে গেলো প্রোটিন-সঙ্গীত (চিত্রঃ থাইমিডাইলেইট সিনথেইজ এ’ প্রোটিনের  অংশবিশেষের সঙ্গীত রুপ।)!

থাইমিডাইলেইট সিনথেইজ এ’ প্রোটিনের  অংশবিশেষের সঙ্গীত রুপ।

আর সঙ্গীতটি শুনে নিতে পারেন এই ঠিকানায়। বিজ্ঞান ও সঙ্গীতের আরো মজার সব তথ্যের জন্য ঘুরে আস্তে পারেন এই ওয়েবসাইটটি।   

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *