Skip to content

স্ত্রীর পত্র

প্রিয়তমেষু,

রাতে রবি ঠাকুরের ‘স্ত্রীর পত্র’ পড়েছিলাম নিদ্রালু চোখে। তাই বুঝি স্বপ্নে এসেছিলে তুমি। অন্ধকার রাত, শুধু ল্যাম্পপোস্টের আলো। সিএনজিতে পাশাপাশি বসে কোথাও যাচ্ছি দুজনে। দুজনের চোখ সামনের দিকে। লাল ট্রাফিক লাইটের দিকে চেয়ে তুমি বললে, ‘আগামি মাসে আমার বিয়ে’। তারপর মাথা নিচু করে আমার দিকে ফিরলে। আমার হাতের ঠান্ডা আঙুলগুলো চেপে ধরে মৃদুস্বরে বললে, ‘সরি’।
আজ ঘুম ভাংলো বেলা করে।

সারাদিন থেকে-থেকে আঙুলগুলো ছুঁইছি। তোমার ‘সরি’তে আন্তরিকতা ছিলো, আমার মন ভিজিয়ে দিয়েছিল। স্বপ্ন তো তা-ই, বাস্তবে যা হয় নি কখনো, হবেও না। কাল ছিলো ছুটির দিন। সপ্তাহের অন্ত। ফুরসত মিলেছিল পেছনে ফিরবার। তোমার কন্ঠস্বর আজো ঠিকঠিক মনে আছে। কন্ঠের উন্থান-পতন, বড্ড ন্যাকা-ন্যাকা ‘বাবু’ ডাক। ‘বাবু’ ডাকে আজ আমার বিরক্তি আসে না, বুক ভেঙ্গে আসে। কন্ঠ দিয়েই শুরু হয়েছিল আমাদের প্রেম। শব্দের মায়াজালে আমরা একে অন্যকে চিনেছিলাম, অন্তত ‘চিনি’ বলেই ভেবেছিলাম।

স্কাইপ-মেসেঞ্জারের যুগে আমরা ছিলাম ‘সেকেলে’। মুখ দেখাদেখি হয়েছিলো বহু পর। তাই বুঝি চোখ-ঠোঁট-হাসি মুছে গিয়ে তোমার মুখটা ঝাপসা হয়ে গেলেও তোমার কন্ঠের ছুঁড়ি আমাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে।

কি দুর্ধর্ষ আনন্দের দিনগুলো ছিলো আমাদের। একে অন্যের পৃথিবী ছিলাম। একে অন্যকে পাশে নিয়ে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়িয়েছিলাম, বালির সৈকত থেকে প্যারিসের আইফেল টাওয়ার। কিন্তু হায়। ধ্রুবতারা খুঁজে পেয়েও দুর্ভাগারা গতিহারা হয়।

লোকে বলে, নারীর মাঝে থাকে ‘মা’ রূপ। আবার কেউ কেউ বলে, এ যেন নারীকে শুধু এক রুপে বন্দি করা। মা দূর্গার তো কেবল একটি রূপ নয়। আমার মাঝে হয়তো ‘মা’ ভাব প্রবল ছিলো। তোমাকে আমি রক্ষা করতে চাইতাম, ভিতরের আর বাইরের সব বালা থেকে। পর্দার ভিলেনরা বাইরে থেকে আসলেও বাস্তবের ভিলেন থাকে আমাদের মনে। মনই নায়ক, মনই খল। আমি আমাদের সব খল থেকে দূরে রাখতে চাইতাম।

বাড়াবাড়ি ভাল নয়, বুজুর্গরা বলেন। তাই আমার সলিল সমাধি হয় আমার অভিমানের খেয়ায় ডুবে। কি করে পেরেছিলে এক বীভৎস খলনায়কের মুখে আমায় হেলায় ছেড়ে দিতে? আমি আজন্ম অভিমানী, তোমার তো অজানা ছিল না!রবি ঠাকুরের নায়িকারা জানতেন না, তারা কত ভাগ্যবতী ছিলেন। শুধু রূপ আর বুদ্ধির বাহার বলে নয়; তাদের জীবনে যে পুরুষ গত হতেন, তারা খুব কমই ভবিষ্যতে দৃশ্যমান হতেন।

মিলেনিয়াল বাঙালিরা বড় হতভাগা, প্রযুক্তির সাত-সতেরো পাঁকে এরা বাঁধা। তাই ‘প্রাক্তন’ কখনও ‘গত’ হয় না। প্রাক্তনের হাসিমুখ, কালো চোখ, কোন আকর্ষনীয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ ছবি কিংবা প্রাক্তনের মুখরোচক গসিপ তাই থেকে থেকে ভেসে আসে জ্বলজ্বলে স্ক্রিনে। এ ভয়ঙ্কর যুগে কোন কিছুর সমাপ্তি নেই, কোন স্মৃতির মৃত্যু নেই।আজকের এই বর্তমান কি সত্যি? তোমার আমার হাতের রেখায় এই বুঝি লেখা ছিল? আমাদের ভালোবাসা কি ভুল ছিল? ভালোবাসা কি ভুল হয়? ভালোবাসা তো নিষ্পাপ। সাদা চুল, কুঁজো পিঠ নিয়ে ব্যাল্কনিতে বসে দুজনে আকাশ দেখব, এই স্বপ্ন দেখা কি কখনও ভুল হতে পারে? তুমি-আমি দুজনেই ভুল মানুষের সাথে সাত পাঁকে জড়িয়েছিলাম। কেনো সাত পাঁক বলে, এখন বুঝতে পারছো তো! সাত’শ পাঁকও বলতে পারত। এ পাঁক থেকে কোন মুক্তি নেই। মুক্তি নেই। মুক্তি নেই।

তুমি ভর্তি অতীত, আর তুমি শূন্য ভবিষ্যত। দুটোই তাড়িয়ে বেড়াবে। অথচ তোমার সাথে গাঁটছড়া আর বাঁধতে পারবো না। তোমার নিষ্ঠুরতা ক্ষমা করেছি কিন্তু বিস্মৃত হতে পারিনি। অতিসাধারণই রয়ে গেলাম আমি, নির্বাণ লাভের ধারে-কাছেও যেতে পারলাম কই?তবু আমার হৃদয়ে আর স্মৃতিতে রয়ে যাবে তুমি। লায়লি-মজনু, রোমিও-জুলিয়েট নয়, আজকের যুগের বাস্তবতা হল পিট-জোলির ব্র্যাঞ্জেলিনা। ট্র্যাজেডিই অমর হয়। প্রেমগাঁথা নয়। ভালো থেকো।

PS: I love you.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *