শেষ পর্ব
স্কুল পড়ূয়া শিশুদের হাতে স্মার্ট ফোন বা একটি এনালগ ফোন তুলে দেন অনেক অভিভাবকই। অনেক সময়ই কাজটি করেন সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে, যাতে যেকোনো সময় সন্তান নরাপদ আছে কি না খোঁজ নিতে পারেন (কিংবা সন্তানের প্রাইভেসির তোয়াক্কা না করে স্পাইং করার জন্য)। শিশুর হাতে স্মার্টফোন তুলে দেয়া কতখানি ভূল সিদ্ধান্ত, এতক্ষনে নিশ্চই বুঝতেই পারছেন। তবে শুধু ইন্টারনেটের যথেচ্ছ ব্যবহার, ভিডিও গেইম খেলা ইত্যাদি ছাড়াও বিভিন্ন app এর ব্যবহার, এমনকী বার বার টেক্সট করা ও নোটিফিকেশন থেকেও আপনার সন্তানের ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রতি আসক্তি তৈরি হতে পারে। এই শিশুদের নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ কমে যায়। বাংলাদেশের মত অপরাধপ্রবণ দেশে শিশুর হাতে ফোন শিশুকে নানা বিপদের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। মস্তিষ্কের ছবি তুলে বিশ্লেষণ করা গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুর গেইম খেলার প্রতি আসক্তি অনেকটাই মাদকের প্রতি আসক্তির মত একইরকম প্রভাব তৈরি করে শিশুর মস্তিষ্কে। ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তি মস্তিষ্কের frontal lobe এর গঠনে পরিবর্তন আনে।
এছাড়াও স্ক্রিন টাইম মস্তিষ্কের আরো কিছু পরিবর্তন আনে যার প্রকাশ হয় শিশুর নানা অস্বাভাবিক আচরণে, যার মাঝে রয়েছেঃ শেখার ক্ষমতা কমে যাওয়া, একই কাজ বারবার করা, lack of socio-emotional regulaion সহ আরও হরেক রকম আচরণগত সমস্যা। মাত্র ৬-১৮ মাস বয়সী থাইল্যান্ডের শিশুদের মাঝে অতিরিক্ত টিভি ফলস্বরূপ ওদের মাঝে emotional reactivity and aggression দেখা গেছে। ২ ঘন্টার বেশি স্ক্রিনে সময় কাটানো ৫-১৮ বছর বয়সী শিশুদের মাঝে বিষণ্ণতার লক্ষণ দেখা গেছে। শুধু তাই না অন্ধকারে অর্থাৎ ডিজিটাল ডিভাইসে ব্যবহার করা শিশুদের মাঝে আত্মহত্যা এবং ডিপ্রেশনের প্রবণতাও বেশি থাকে এবং সাথে স্বাভাবিকভাবেই আমরা বুঝতে পারি যে স্ক্রিনে বেশি সময় কাটানোর শিশুরা সামাজিকভাবে সমবয়সীদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করার জন্য কঠিন হয়ে যায়।সমাজের সাথে ওরা একাত্ম হতে অসুবিধা বোধ করে। ২ থেকে আড়াই বছর বয়সী কোরিয়ান শিশুদের উপর গবেষণায় দেখা গেছে টিভি টাইম বাড়ার সাথে সাথে শিশুর কথা বলা শুরু করতেও দেরী হয়। ৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের যারা দৈনিক ২-৩ ঘণ্টা টিভি দেখে তাদের কথা বলা শিখতে দেরি হওয়ার সম্ভাবনা, যে শিশুরা ১ ঘন্টার কম টিভি দেখা তাদের চেয়ে ৩ গুণ বেশি। একটি গবেষণায় আড়াই বছর বয়সের যে শিশুরা অতিরিক্ত টিভি দেখেছে, তাদের যখন ৫ বছর বয়স পর্যন্ত ফলো-আপ করা হলো। দেখা গেলো ওদের শব্দ শেখার ক্ষমতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম, ক্লাসে মনোযোগ কম, সমবয়সীদের সাথে সখ্যতা স্থাপনের ক্ষমতাও কম।
স্ক্রিন টাইম বাড়ার সাথে সাথে শিশুর intellectual functioning যে কমে যায়, সেটা অসংখ্য গবেষণায় প্রমানিত হয়েছে। এত অল্প বয়সে একটি শিশুর এর চেয়ে বেশি ক্ষতি আর কী হতে পারে?এখানে আগের একটি পর্ব থেকে মনে করিয়ে দিতে চাই, কিছু কিছু অনুষ্ঠানের ভাল প্রভাব রয়েছে শিশুদের মাঝে। যেসব ভিডিও গেইম বা অনুষ্ঠানে নানা চরিত্র তুলে ধরে, চরিত্ররা নিজেরা নিজেদের সাহায্য করে, শিশুকে সরাসরি প্রশ্ন করে, বিঁকোটিটি বস্তু চেনাতে সাহায্য করে, সে অনুষ্ঠানগুলো শিশুদের শিখতে চেষ্টা করে ও ওদের মাঝে prosocial behavior বাড়ায়। বিশেষ কিছু টিভি প্রোগ্রাম ৩-৫ বছর বয়সী শিশুদের ভাষা শেখায় সাহায্য করে। ‘ডোরা, দ্য এক্সপ্লোরার’ প্রোগ্রামের সাথে আপনারা অনেকেই পরিচিত। আড়াই বছর বয়সী শিশুদের ভাষা শেখায় এই প্রোগ্রামটি বিশেষভাবে সহায়ক। একই ব্যপার নিশ্চিত করা গেছে ‘সিসেমি স্ট্রিট’ অনুষ্ঠানের বেলায়ও। মজার ব্যাপার হল, বেশ ছোট বয়সী শিশুদের বেলা আবার এই অনুষ্ঠানগুলোর উল্টো প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। অর্থাৎ, এই টিভি প্রোগ্রামগুলো শিশুর গ্রোথে সহায়ক একটা বিশেষ বয়সের পরে।
এখানে বলে রাখা ভাল, অনুষ্ঠানের প্রভাব নির্ভর করে শিশু একা টিভি দেখছে না কারো তত্বাবধানে দেখছে তার উপরেও। অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে এইসব অনুষ্ঠান দেখা শিশুরা কয়েকগুন বেশি শেখে! তবে হাজারো অনুষ্ঠানের ভিড়ে শিশুর বেড়ে উঠায় সত্যিকারের সহায়ক অনুষ্ঠানের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য।
