***********************
৭৬% নর্থ আমেরিকান ড্রাইভারেরই ধারণা যে তারা বেশ ভালো ড্রাইভার। অথচ আরেকটু গুতাগুতি করতেই পাওয়া গেলো, এই এদেরই ৯৩% স্বীকার করেছে ড্রাইভ করা অবস্থায় অনিরাপদ আচরণ করার কথা। তাহলে তারা ভাল ড্রাইভ করে এই আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি কী?
২০১৮ তে Patrick R Heck দুটো ন্যাশনাল সার্ভের ডাটা নিয়ে কাজ করে দেখান, ৬৫% আমেরিকান নিজেকে এভারেজের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান ভাবে। মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের নিজেদের বুদ্ধিমান ভাবার ঝোঁক বেশি। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বেশি শিক্ষিতদের মাঝেও নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবার প্রবণতা বেশি।
একে বলা হয় overconfidence বা নিজের উপর অত্যাধিক আস্থা। সত্যি বলতে কি, নিজেকে অন্যের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান ভাবা আমাদের human psychology র একটা বৈশিষ্ট্য। একে বলে Dunning-Kruger Effect, যার অর্থ অন্যদের তুলনায় নিজেকে বেশি স্মার্ট আর সমর্থ ভাবা। এই ভাবনাটা বিশেষ করে তাদের কাজ করে, যারা নিজের আচরণের ব্যপারে অসেচতন এবং/অথবা যাদের বোধশক্তি/cognitive ability কম।
বাংলাদেশীদের উপর এমন সার্ভে হলে কেমন হবে? আমার ব্যক্তিগত ধারণা পরিসংখ্যানটা বোধ হয় অন্তত ৬৫ থেকে ৯৫ (কিংবা ১০০?) ভাগে উঠে আসবে। দেশের মানুষ Dunning – Kruger Effect দেখাচ্ছে, দিনে দিনে আরো বেশি দেখাচ্ছে। আমরা সবাই সব বুঝি। পর্যবেক্ষণই তৈরি হয়নি যার, সে বিজ্ঞান বোঝে। তন্ত্র বোঝে না যে, সে জায়গা নিয়েছে মন্ত্রণালয়ে। নির্মোহভাবে যে দেখতে শেখেনি, সে বিশ্লেষক হয়ে টকশোতে। আত্মা যে বুঝলো না, সে ধর্ম দেখিয়ে ফতোয়া দেয়। এ ও কি সম্ভব? সম্ভব না, তবু প্রত্যেকেই যেহেতু বেশি বুঝি, তাই আমরা একে অন্যের territory তে গিয়ে মনের সুখে পিন্ডি চটকে আসি।
কারো সাথে এক কাপ চায়ের সমান সময় কথা হলো বা কারো সাথে কাটালেন এক সন্ধ্যা। ব্যাস! আপনি তার নাড়ি-নক্ষত্র অতি আস্থার সাথে বুঝে ফেললেন। কীভাবে নিশ্চিত হবেন, ওই অল্প সময়ে আপনি যা দেখলেন, তা ঐ মানুষটার স্বাভাবিক আচরন represent করে কি না? কে জানে, আপনি হয়ত ঐ সকাল, ঐ দিন, আগের রাত বা গেলো সপ্তাহের ঘটনাবলি দিয়ে প্রভাবিত হয়ে তিনি নিজেকে কেমন করে project করছেন তারই একটা ছাপ দেখলেন।
সদ্য-/স্বল্পপরিচিত কেউ আপনার সাথে কথা বলতে গিয়ে তার চরিত্রের নানা মুখোশ থেকে সেটিই বেছে নেবেন যা, ১) আপনাকে please করবে, ফলে আপনি তাকে গ্রহণ করবেন, অথবা ২) যে ধারণা তিনি নিজের সম্পর্কে আপনাকে দিতে চান (manipulation) আপনি সেটিই পাবেন। হ্যাঁ, স্বল্পপরিচয়ে তার core সম্পর্কে যদি কিছুটা ধারণা পেতে চান, তার ideology সম্পর্কে জানুন, তার দর্শন সম্পর্কে প্রশ্ন করুন। যতক্ষণ আপনার প্রশ্ন shallow/superficial/ভাসাভাসা হবে, ততক্ষণ আপনি তাকে জানবেন না, তার মুখোশকে জানবেন।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমরা সমাজে fit in করার গুরুত্ব বুঝে যাই, আর নিজেদের নানা মুখোশের আড়ালে ঢাকতে থাকি। এভাবে কখনও কখনও বা একসময় মুখোশের আড়ালে মানুষটার স্বতন্ত্রই হারিয়ে যায়। আমরা লাল-নীল-কমলার রংধনু থেকে সব এক ধূসর রঙে পরিণত হই, সমাজ থমকে যায়। সমাজে জোর করে fit in করতে চাওয়া তাই সমাজের জন্যই অহিতকর। কাজেই, কারো কলেজের নাম শুনেই আপনি তাকে জাজ করে ফেললেন, কোন শহরের জেনে তার চরিত্র বুঝে ফেললেন, এটা কতটুকু ন্যায্য? মানছি, জাজ করে চরিত্রের সরলীকরন করা সম্ভব। নিজের নিরাপত্তার জন্যই আপনি হয়ত সামনের মানুষটাকে assess করবেন চটজলদি। কিন্তু সেই assessment কে যদি মুক্ত না রাখেন, যদি পরিবর্তনের সুজোগ না রাখেন, তাতে আপনি বঞ্চিত হবেন মানুষের বিচিত্রতা উপভোগ থেকে। দম্ভের সাথে আটকে থাকবেন আপনার আট কুঠুরিতে।
নিজের প্রতি অতি আস্থাবলে এরকম নিতান্তই ব্যক্তিগত জাজমেন্ট আমরা ছড়াতে থাকি। it’s 2020, everything spreads, right?! এটা অন্যের প্রতি অন্যায়, নিজের প্রতিও। কারো সোশ্যাল মিডিয়া appearance দেখে catagorize করে ফেললেন? কারো দু’ছত্র পোস্ট তাকে পূজা করতে শুরু করলেন? কিংবা trash bin এ ফেলে দিলেন? Online Platform এ আমরা নিজেদের যে কোনো একটা-দুটা দিক তুলে ধরি। অনলাইনে আমাদের বেশির ভাগই সচেতনভাবে নিজেদের জন্য মুখোশ তৈরি করে। এই মুখোশের কাজ নিজেকে জাহির করা, একটা কৃত্তিম ইম্প্রেশন তৈরি করা। টিকে থাকতেই মানুষ এই কৃত্তিমতার আশ্রয় নেয়। তাই দুই মিনিটের প্রোফাইল ভিজিটে কাউকে জাজ করা বৃথা।
শিক্ষার সাথে সাথে আমাদের জাজ করার প্রবনতা বাড়ে, আমার বিস্মিত পর্যবেক্ষণ। অশিক্ষিত লোক “অয় একটা পাগল” বলে বটে কিন্তু যে কাউকেই গ্রহণ করে নেয়। কিন্তু শিক্ষা আমাদের বিশ্লেষণ করতে শেখায়। আর এই গুনটাই যখন আমরা অতিরিক্ত/overdo করি, আমরা হয়ে যাই জাজমেন্টাল।
জাজমেন্ট নিজের ভেতর রেখে দিতে পারলেও হয়তো সমাজে তার প্রভাব কম পরত। কিন্তু এই জাজমেন্টকে আমরা দম্ভভরে প্রকাশ করি। Dunning – Kruger Effect এর কারনে। আমাকে আপনার ভালো লাগে না। কারণ আমি ফালতু লিখি। হতেই পারে। আপনি আমার সাথে দূরত্ব তৈরি করলেন, আপনার স্বাধীনতা অবশ্যই। কিন্তু আমার ব্যপারে আপনার premature জাজমেন্ট আপনি যখন নানা জায়গায় প্রকাশ করলেন, তখন কিন্তু আর বিষয়টা ঠিক নেই। আপনার আর আমার মাঝে কোনো সম্পর্ক তৈরি হলো না। আমার লেখা আপনার ভাল না লাগলেও হয়ত লেখার থিমটা খারাপ ছিল না। থিমটা খারাপ হলেও হয়ত শব্দের ব্যবহার আপনার খারাপ লাগেনি। লেখার সবকিছু খারাপ লাগলেও হয়ত লেখার পেছনের উদ্দেশ্যটা ভালই ছিল। আমার লেখা (এবং সেইসাথে আমাকে) বর্জন করার একটি কারণ থাকলে, তাকে গ্রহণ করার দশটি কারণ থাকতে পারে। কিন্ত আপনাকে ঠিক করতে হবে আপনি কি মানুষকে তাদের বেশ কিছু গ্রহণযোগ্য বৈশিষ্ট্য থাকা স্বত্বেও শুধু একটা কিছু আপনার সাথে মেলে না বলেই দুরত্ব তৈরি করবেন কি না।
অমুকের রাজনৈতিক দর্শন আপনার পছন্দ হয় না, তমুকের ধর্মীয় দর্শন আপনার পছন্দ হয় না, সমুকের চেহারা সুরত, পোশাক আপনার পছন্দ হয় না। কখনও ভেবেছেন কি, ভাসা ভাসা দেখেই যে আপনি নিজেকে ছাড়া পৃথিবীর যাবতীয় মানুষকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিচ্ছেন, তারা কি আসলেই কি অতখানি অপর্দার্থ?
একটু কাছে গেলেই হয়তো তার আর আপনার মাঝের মিলটুকু চোখে পরতো! হতে পারে না, কারো দর্শন আপনার উল্টো কিন্তু তার poise চমকপ্রদ? একটু সময় দিলেই হয়তো দুজন দু’জনের থেকে শিখতেন। একটু উদ্যমী হলেই হয়তো দু’জন দু’জনের জীবনে ইতিবাচক অবদান রাখতে পারতেন।
মাদার তেরেসার একটা কথা দিয়ে শেষ করি, “If you judge people, you have no time to love them.” বিরামহীনভাবে নিজেদের মাঝে ছোট্ট ছোট্ট পার্থক্যগুলো না খুঁজে, মিলটুকু নিয়ে কি আমরা অর্থপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে পারি না? আমরা সভ্য হলেই সভ্যতা এগোয়।
