(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
আমি হেনরিয়েটা বলছি। হেনরিয়েটা ল্যাক্স। আদর করে তোমরা আমায় হেনি ডাকতে পারো। আজ থেকে ঠিক একশ বছর আগে আমার বাবা-মা আমাকে হেনিই ডাকতেন। আমি কে, জানতে চাইছ তো? আমি সে-ই জন, যা তোমরা সবাই হতে চাও, কিন্তু আজ অবধি কেউ হতে পারোনি। আমি হেনরিয়েটা, সে-ই জন, যে অমরত্ব লাভ করেছি। তোমরা একটু রুপের জন্য, তারুন্যের জন্য কত ডাক্তার-হাসপাতাল কর! আমাকে কিন্তু কিচ্ছু করতে হয়নি! আমায় না জানিয়েই ওরা আমায় অমর করে দিলো। মৃত্যুর আগেও ধাড়ি-বদমাশগুলো একটা বার বলল না, ‘হেনি, তুমি অমর হবে, সারা পৃথিবী ভোগ করবে তোমার অমরত্বের ফল, শুধু তুমি ছাড়া’।
দেবরাহ’র জন্য সবচেয়ে বেশি বুক পুড়ে। লরেন্স, এলসি, সনি, জোসেফ। ওরা সব মরে গেলো। আমার সন্তানদের নশ্বর দেহ মিটে গেলো মাটিতে। আর আমি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি, পৃথিবী জুড়ে, আমার অনেকগুলো কপি হয়ে। ওরা যেমন খুশি আমাকে নিয়ে খেলছে, ভাঙছে, গড়ছে। আমার ভয়ঙ্কর অমরত্বে আমার কষ্ট হয়। অমর হলে কী হবে, জাতে-পাতে তো এক কালো আমেরিকান অল্পবয়সী মেয়ে আমি। মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে রোগে শোকে ছুটে গিয়েছিলাম জন হপকিন্স গাইনোকোলজি সেন্টারের কালোদের পরীক্ষা ঘরে। সে বছরই মরে গিয়ে আমি অমর হয়েছিলাম। আমার স্বামী-সন্তানেরা জানতেও পারেনি, আমার কী হয়েছিল। কালো আমেরিকান বলে ভেবো না আমার রূপ কম ছিলো! হাসি-আনন্দ-রং-রূপ সব ঠিকঠাক ছিল। গুগলকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে কালো আমার আলো ঝলমল ছবি।
জোসেফের বয়স তখন চার কি পাঁচ মাস। ক’দিন ধরেই আমার তলপেটে ছোট্ট গুটলির মত শক্ত করে কী যেনো একটা ঠেকছিল। পাড়ার মেয়েরা তো হৈ হুল্লোড় তুলে দিলো, আমি মা হতে চলেছি। পাঁচ সন্তানের জননী আমি, মা হওয়া কেমন ভালো করেই জানা ছিলো। আমি ঠিক বুঝেছিলাম এটা অন্য কিছু। খুব খারাপ কিছু। সিফিলিস নয়তো? হাসপাতালে যেতেও ভয় হয়। সাদা ডাক্তারগুলো কালোদের যত না চিকিচ্ছে করে, তার চেয়ে বেশি অসুখ বিসুখ ঢুকিয়ে দেয়। কালো শরীর যেনো শরীর নয়, গিনিপিগ। তলপেটের যন্ত্রনা আর সইতে না পেরে যেদিন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম, সেদিনই আমার জীবনটা বদলে গিয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন, জরায়ুমুখের ক্যানসার। তার ক’মাস পরই আমি মর্ত্যের মায়া ছাড়ি। আমার সংসারটা ছন্নছাড়া হয়ে যায়। আমরা তামাক চাষী ছিলাম। চিকিৎসার টাকা তো চাট্টিখানি কথা নয়। আমার মৃত্যুর পর, আমার স্বামী, ডে, একসাথে দুটো চাকরি শুরু করে, বড় ছেলে স্কুল ছেড়ে কাজ শুরু করে ছোটদের দেখভাল করতে।
ওরা আমাকে বাঁচাতে চেয়েছিল। তখন চিকিৎসা বলতে ছিল রেডিয়েশন। ডাক্তার বললো, জরায়ুমুখের কোষগুলো বদলে গেছে, ওগুলো আর স্বাভাবিক নেই। ওরা এখন ভয়ঙ্কর কোষ, ছড়িয়ে পরছে সারা দেহে। রেডিয়েশন দিয়ে ওদের মারতে হবে, তবেই আমার মুক্তি। তীব্র সে রেডিয়েশনে আমার দেহ পুড়ে গেলো। কিন্তু মরল না বজ্জাত ক্যান্সার কোষগুলো। বরং তরতর করে সঙ্খ্যায় বেড়ে উঠছিল ওরা। ওদের আগ্রাসনে ক’দিন পরই আমি মরে যাই। ঘরে আমার তখন দুধের শিশু, জোসেফ। মরতে মরতে এত অসহায় লাগছিল নিজেকে, কি বলব! নিজের জন্য নয়, বাচ্চাদের জন্য, ডে’র জন্য। ঘুণাক্ষরেও কখনও ভাবিনি এত অল্প সময় দিয়ে বিধাতা আমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্ত মরেও সব শেষ হল না।
আমার যখন ক্যান্সার ধরা পরে, সেই পঞ্চাশের দশকের কথা। চিকীৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার তখন বসন্ত শুরু হচ্ছে হচ্ছে ভাব। সেই বসন্তের পালে আমি দিয়েছিলাম হাওয়া। জীবের কোষেই নাকী জীবনের রহস্য। তখন ব্যাঙ আর পোকামাকড়ের দেহ থেকে কোষ নিয়ে ক্রিত্তিমভাবে কিছুদিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখা যেতো। ওইসব কোষ দিয়েই বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করতেন জীবনের রহস্য ভেদ করতে, রোগের কারণ, প্রতিকার খুঁজে বের করতে। কিন্তু পোকামাকড় দিয়ে মানুষের রোগের গবেষণায় ঠিক জুত হচ্ছিল না। আমার ডাক্তার হাওয়ার্ড, বায়োপ্সির নাম করে আমার কিছু ক্যান্সার কোষ সরিয়ে রাখলেন গবেষণার জন্য। একবার আমার অনুমতি চাইলেন না। একবার বুঝিয়ে বললেন না, একবার আমায় জানালেন না পর্যন্ত।
শিক্ষিত লোকগুলো এমন হয় কিভাবে বলতে পারো? আমার ক্যন্সার কোষগুলো এতই শক্তিশালী ছিল যে, আমার শরীরের মত করেই ওরা ল্যাবের ক্রিত্তিম পরিবেশেও ধাই ধাই করে সংখ্যায় বাড়তে লাগলো। এই প্রথম কোন মানুষের কোষ ল্যাবে চাষ হতে লাগলো। আমার কোষ এক বিজ্ঞানী থেকে গেলো আরেক বিজ্ঞানীর হাতে, এক দেশ থেকে গেলো আরেক দেষে। আমার কোষ পৃথিবীর প্রথম অমর কোষ, এদের মৃত্যু হয় না। পোলিও রোগের চিকিতসার জন্য ফ্যাক্টরি তৈরি করে আমার কোষের চাষ হয়েছিলো। যখন দরকার নেই,তখন আমাকে ওরা ফ্রিজে ঘুম পারিয়ে রাখলো। দরকারমতো আবার বাড়াতে লাগলো। আমার শরীরের অংশ দিয়ে করল ওরা ক্যান্সার, এইডস, আরও কতশত রোগের গবেষণা। আমার নামের অদ্যক্ষর থেকে ওরা আমার কোষের নাম দিলো ‘হিলা’ (HeLa cell).
একটা বার যদি মৃত্যুর আগে জানতাম, এইভাবে কাজে লাগবো, তাহলে হয়ত মরণেও একটু শান্তি থাকতো। ওরা আমায় জানায়নি। ডে’কেও জানায়নি। আমার ছোট্ট সন্তানরা ভুলেই গেছিল, তাদের মা কিভাবে মরেছে। আমার পরিজন, কেউ জানলো না, হেনরিয়েটা শুধু পৃথিবী থেকে নেয়নি, কিছুটা হলেও পৃথিবীকে দিয়েছে। আমাকে নিয়ে লেখা বই আজো বেস্ট সেলার হয়, আমাকে নিয়ে সিনেমা হয়। আর আমি পৃথিবিজুড়ে হাজারো ল্যাবে আমার শরীর খুঁজে বেড়াই।
পৃথিবীর নিয়ম বলে, মৃতদের কোনো প্রাইভেসি নেই, দাবিদাওয়া, মান-অভিমান নেই। আমারই দেহের অংশ কৃত্রিমভাবে বেঁচে থাকবে যতদিন দুনিয়া থাকবে, শুধু আমি থাকবো না, আমার কোনো কথা থাকবে না। আমার কোষ অমর হবে, কিন্তু আমি হব না। আমার কোষে রোগের চিকিৎসা হবে, কিন্তু কেউ আমার নাম জানবে না। আমার মৃত্যু পুঁজি করে শিল্পির শিল্প হবে, ব্যবসায়ীর টাকা হবে, কিন্তু আমার সন্তানদের স্কুলে পড়া হয়নি। আমি এক হতভাগ্য অমর। আমি হেনরিয়েটা ল্যাক্স, তোমাদের হিলা।
