Skip to content

এখানে হাতে-কলমে সুখ শেখানো হয়

সুখ কি শেখা যায়?

প্রমোশন চেয়েছিলেন, পেয়ে গেলেন, কিন্তু আগের চেয়ে যে সুখী হলেন, তা না। মানুষ যা কিছু চায় জীবনে, ভাবে শুধু এইটুকু নাই বলেই তার অত সন্তাপ, সেটা পেলেই যে সে সুখী হয়, তা নয়। গবেষণা বলে, নোবেল পেয়ে বিজ্ঞানী সুখী হননি, অলিম্পিকে সোনা জিতে খেলোয়ার সুখী হননি, একজন বিলিওনিয়ার সম্ভাব্য সব পেয়েও সুখী নন। সুখী তবে কে, সুখ তবে কোথায়?

সপ্তম শ্রেণির কিছু শিক্ষার্থীর উপর একবার একটি গবেষণা করা হয়েছিল। শিক্ষার্থীদের দুটি দলে ভাগ করা হলো, একদলে হাসিখুশি শিক্ষার্থীরা, অন্যদলে বিষন্ন শিশুরা। তারপর ওদের বয়স যখন ত্রিশ হলো, এই দু’দলের জীবনের বিভিন্ন দিক তুলনা করা হলো। সুখী দল তাদের চাকরিতে গড়পড়তা মানুষের চেয়ে দশ শতাংশ বেতন বেশি পাচ্ছিলেন। অন্যদিকে বিষন্ন দল পাচ্ছিলেন ত্রিশ শতাংশ কম। সুখী দল তাদের জীবন নিয়ে তুলনামূলক ভাবে বেশি সন্তুষ্ট ছিলেন। এরকম আরো কিছু গবেষণা রয়েছে যেগুলো প্রমাণ করে খুব অল্পবয়স থেকেই জীবনের প্রতি আপনার সহজাত দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আপনার ভবিষ্যৎ জীবনের সাফল্য নির্ধারিত হযে যাচ্ছে।

আমার কাছ বিষয়টা এরকম মনে হচ্ছে, জীবনে কী কী পেলাম, তাতে আমার সুখ-আনন্দ আসবেনা। বরং আমি কতটুকু সুখী, সেটাই ঠিক করবে আমি জীবনে কী কী পাবো! একজন ছাত্র যখন সব আনন্দের মুহূর্ত থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়ে শুধুই পড়াশুনা করছে, গবেষণা বলে যে তার সাফল্যের সম্ভাবনা (ভালো চাকরি, বেতন ইত্যাদি) বরং কম। একই ব্যাপার প্রযোজ্য যারা গভীর রাত পর্যন্ত অফিসের কাজ করতে গিয়ে পরিবারকেই সময় দিতে পারছেননা তাদের ক্ষেত্রেও।

সুখী মানুষ বাঁচে বেশিদিন, তাদের দাম্পত্য জীবনের বন্ধন গভীর হয়, সম্পর্কগুলো অর্থবহ হয়, এমনকি চাকরির ক্ষেত্রে বেশি সাক্ষাৎকারের সুযোগ আসে।

এসবই শয়ে শয়ে মানুষের উপর গবেষণা করে জানা গেছে। সাফল্যে সুখ আসে না, সুখে সাফল্য আসে।আমি তাহলে কিভাবে আগে নিজেকে সুখী করতে পারি?

এখন তবে প্রশ্ন, সুখী হওয়া কি শেখা যায়?

এর উত্তর আছে একটি বিখ্যাত গবেষণায়। এই গবেষণায় অংশ নিয়েছিলেন পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ। তাদের একজন ছিলেন জন এফ কেনেডি। ১৯৩৮ সালে এই গবেষণার শুরু, এখনও চলছে। হার্ভার্ড কলেজ থেকে বেছে নেয়া হয়েছিল সবচেয়ে মেধাবী ২৬৮ জনকে। একই সাথে দরিদ্রতম কিছু পাড়া থেকে নেয়া হয়েছিল এমন ৪৫৬ জনকে যারা সংগ্রাম, ভায়োলেন্স ও নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছিলেন। এবার আমৃত্যু এই দুই দলের লোকদের সাক্ষাৎকার নেয়া ও নানান মেডিক্যাল পরীক্ষা করা হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে, তাদের জীবনের বিভিন্ন স্টেজে (বিয়ে, চাকরি, বাবা-মা হওয়া, প্রোমোশন ইত্যাদি)। এই স্টাডির অনেকেই এখন বেঁচে নেই তবে বর্তমানে তাদের সন্তানদের একই ভাবে ফোলো-আপ করা হচ্ছে। যেসব তথ্য উঠে এসেছে এই গবেষণায়:

* মদ খাওয়া শুধু শারীরিক ক্ষতি নয়, অল্পবয়সে মৃত্যুর পাশাপাশি চাকরি ও বিবাহিত জীবনেও ব্যর্থতার কারণ।

* মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হয়ে যাবার পর আরো বেশি অর্থ উপার্জন মানুষকে আরো বেশি সুখি করে না। এবং সেটা ছয় বা তার চেয়ে অনেক বেশি অঙ্কের বেতন হলেও না।

* কর্মজীবনে সাফল্য, কঠোর পরিশ্রম এসব মানুষকে আরো বেশি সুখি করে না।

* বয়স্ক অবস্থায় যখন তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাদের জীবনের সুখের মুহুর্ত কোনগুলো, জীবনের প্রাপ্তিগুলো কী কী, তাদের উত্তর ছিল বিস্ময়কর (তাই কি?)। সার্টিফিকেট, মেডেল, বা জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য এর চেয়ে তাদের সুখী করেছিল তাদের পরিবার, সন্তান সন্ততি, নাতি নাতনি, বন্ধুরা। এই গবেষনায় আরো উঠে এসেছে যে সাক্রিফাইস করা মানুষেরা বেশি সুখি ছিলেন। নিজেকে নিয়ে অতিমাত্রায় ব্যস্ত থাকার শারীরিক ও মানসিক টোল রয়েছে।

* খারাপ পারস্পরিক সম্পর্কের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ ও আরথ্রাইটিসের মতো রোগের।

এক কথায়, কেউ যখন সহজাতভাবে সুখি হওয়ার ক্ষমতা রাখে, তার ব্যক্তি ও কর্মজীবনে সাফল্য বেশি আসে, শারীরিকভাবে সুস্থ থাকে এবং বেশিদিন বাঁচে।

প্রশ্ন ছিল, এই সহজাত ক্ষমতা কি চেষ্টা করে অর্জন করা যায়?

আমি যদি জন্মগতভাবে কিংবা পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে enthusiasm ও positivity হারিয়ে ফেলি, সেটা কি ফিরে পাওয়া সম্ভব?

উত্তর হচ্ছে, সম্ভব, যদি আমরা চেষ্টা করতে রাজী থাকি। কথায় আছে, যে কোন বিষয়ে মাস্টার হতে বা দক্ষতা অর্জন করতে ১০,০০০ ঘণ্টা সময় দিতে হয়। সেটা একটা নতুন ভাষা শেখা হোক বা কোন পেশাগত দক্ষতা অর্জন। এর চেয়ে আরও অনেক অল্প সময়েই আসলে সুখি হওয়া শেখা সম্ভব।

প্রফেসর ড. লরি সান্টোস এসব গবেষণা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। চিঠিসহ নানা মাধ্যমে তিনি প্রায়ই তার ছাত্রসহ অনেকের জীবন নিয়ে হতাশা এমনকি আত্মহত্যার চেষ্টার কথা জানতে পারতেন। এসব থেকেই ভদ্রমহিলা ঠিক করলেন Yale University তে হ্যাপিনেস কোর্স চালু করার কথা। ভেবেছিলেন জনা তিরিশেক ছাত্র নিয়ে শুরু করবেন, কিন্তু সবাইকে হতবাক করে দিয়ে প্রথম ক্লাসে উপস্থিত হয়েছিলো ১২০০ জন। Yale এর প্রতি চারজন ছাত্রের একজন বেছে নিয়েছিল এই কোর্স। ছোট্ট ক্লাস্রুম থেকে ক্লাস স্থানান্তর করা হল University র কনফারেন্স হলে। এই কোর্সের পরিধি খুব দ্রুতই আরো বেড়েছিল অনলাইনে কোর্সটি চালু হওয়ায়।

কোর্সের শুরুতে প্রত্যেককে ২৩ টি প্রশ্নের একটি সার্ভের উত্তর দিতে হয়েছিলো। সেখান থেকে তাদের সুখের মাত্রা মাপা হল শূন্য থেকে দশ এর স্কেল এ (happiness scale)। এভাবে হাজারো ছাত্রের প্রশ্নোত্তর থেকে তাদের সুখের মাত্রা পাওয়া গেলো দশে সাড়ে ছয়।

কোর্স শুরু হলো। বাড়ির কাজও দেয়া হতো। কাজগুলো সহজ, আবার সহজ নয়। প্রতিদিনের সব কাজের পর এই বাড়ির কাজগুলো করতে একটু অতিরিক্ত এফোর্ট দিতে হতো। প্রথম দিকের কাজগুলো ছিলো এমন, প্রতিদিনঃ

– কাইন্ড কিছু করা, অর্থাৎ অন্যের প্রতি আমাদের ভালোবাসা/সহানুভূতি দেখানো

– আট ঘন্টা ঘুমানো- বিশ মিনিট মেডিটেশন

– কী কী কারণে আপনি জীবনের কাছে কৃতজ্ঞ এমন কিছু কারণ ডায়রীতে টুকে রাখা

ইয়েলের ব্যস্ত ছাত্রদের জন্য এই বাড়ির কাজগুলোই কঠিন ছিলো। যাহোক, কোর্স চলতে লাগলো। সেমিস্টার শেষ হয়ে এল। ২৩ প্রশ্নের সেই সার্ভে আবারও ছাত্রদের দেয়া হল। কয়েক মাসের একটা কোর্স শেষে ছাত্রদের সুখের মাত্রা পাওয়া গেলো দশে প্রায় আট (৭.৯) যা কোর্সের শুরুতে ছিল সাড়ে ছয়।

কোর্স পড়িয়ে লরি কী শিখলেন? লরির ভাবনাগুলোই তুলে ধরি। জীবন আরো বেশি আনন্দময় করে তোলা সম্ভব, কিছু সহজ ফর্মুলা দিয়েই সম্ভব। কিন্তু জেনে শুনেও এই ফর্মুলাগুলো আমরা প্রয়োগ করি না। আর সব immediate priority র ভীড়ে এগুলো হারিয়ে যায়। এমনকি কোচ লরিও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। শরীর ও মনের উপর ব্যয়ামের গুরুত্বের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। অথচ এই কোর্স চালাতে গিয়েই লরির প্রতিদিনের ব্যায়াম গিয়ে ঠেকেছিল সাপ্তাহিক রুটিনে। লরির পরামর্শ, যে কাজগুলো আমাদের ভালো রাখে সেগুলোকে ‘to do’ লিস্টে রেখে বারবার নিজেকে মনে করিয়ে দেয়া।

হাসি-খুশি থাকা? চেক!

হেঁড়ে গলায়/গুনগুন করে গান করা? চেক!

কাছের মানুষকে ফোন বা দেখা করে সময় দেয়া? চেক!

নিজের সাথে নিজে কিছু সময় কাটানো? চেক!

শরীর-মন-মাথাকে একটু ঝালিয়ে নেয়া? চেক!

আপনি চাইলেই হয়। Denial এ থেকে নিজেকে নিজে অবহেলা আর কত?

বিঃদ্রঃ আপনি যদি বিশেষ কোন দুরবস্থায় থাকেন, তবে ভালো থাকার জন্য আপনাকে অবস্থার উন্নতি বা পরিবর্তন করতে হবে। এই লেখায় ধরে নেয়া হয়েছে যে আপনি একটি স্বাভাবিক ও নিয়মিত জীবনে আছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *