ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ, গৌরবের শতবর্ষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত সবাইকে অভিনন্দন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী, শুভানুধ্যায়ী, এমনকি সমগ্র জাতির অহংকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গৌরব অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। তাই শতবর্ষে একজন এলামনাই, শিক্ষক ও একজন বাংলাদেশি হিসেবে নিজেকেই প্রশ্ন করছি, আমাদের পূর্বসূরিদের অর্জনকে ধরে রাখার ও আরও সমৃদ্ধ করার সক্ষমতা এবং যোগ্যতা আমরা অর্জন করেছি কি না। কখনো কখনো ভালবাসা আমাদের যুক্তির ধার কমিয়ে দেয়। তাই মাঝে মাঝে প্রয়োজন গঠনমূলক সমালোচনার। কিন্তু শুধু সমালোচনাতে সমাধান আসে না। প্রতিটি সমালোচনার সাথে থাকা চাই সীমাবদ্ধতাটি অতিক্রম করার জন্য যথাযথ উপায়।
এ দেশের জন্ম ও অগ্রগতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে অসামান্য অবদান। কিন্তু সে অবদানের পাশাপাশি আমাদের দেখতে হবে জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করছে কি না। বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কতটুকু ভূমিকা রাখছে এবং রাখবে। এই লেখাটি যখন লিখছি তখন আমি গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটিতে। কানাডার টরেন্টোতে আরও কয়েকশত সংস্কৃতি ও ভাষাভাষী মানুষের সাথে বাস করছি। নানান expertise এর বিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করছি। একজন গবেষকের দৃষ্টিকোণ থেকে দুটি কথা বলতে চাই। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের মত চমৎকার শুরু হয়নি এমন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি বছর জায়গা করে নেয় পৃথিবীজুড়ে শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায়। আমাদের চেয়ে দরিদ্রতর এবং বেশি অস্থিতিশীল দেশও এগিয়ে যাচ্ছে তাদের শিক্ষা ও গবেষণা খাতে উন্নতির মাধ্যমে। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় যে পর্যায়ে পৌঁছানোর কথা ছিল আজ, আমরা তার ধারে কাছেও নেই। সত্যেন বোস কিংবা কামাল উদ্দিন আহমেদের লিগ্যাসি আমরা কতদূর বহন করতে পেরেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের মানকে কতদূর ধরে রাখতে পারব বলে ভাবছি? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যখন সৃষ্টিশীলতাই হারিয়ে যাচ্ছে, আমরা কি তখন প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিয়ে শুধুই অহংকার আর অস্বীকার করে যাবো? আশা করছি একটি বিষয়ে সবাই একমত হবেন যে, সময় অতি দ্রুত বদলাচ্ছে, সময় হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার প্রতি দ্ৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর।
অবাক হলেও সত্যি, বাংলাদেশ স্বল্প আয়ের দেশ হলেও আমার কাছে অন্তত বাজেটের অভাবকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক মানের গবেষণার পথে প্রথম ও প্রধান অন্তরায় বলে মনে হয়না। দূরদর্শিতা ও বোধের অভাবই গবেষণার পথে আমাদের প্রথম সীমাবদ্ধতা। তাই প্রথমেই আমাদের মনোযোগ দেয়া উচিত গবেষণার জন্য উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াতে। একটি দেশের গবেষণার নেতৃত্ব দেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকে এবং সামগ্রিকভাবেই বাংলাদেশের অগ্রগতিতে গবেষণাকে অত্যন্ত অ-গুরুত্বের সাথেই দেখা হয়। যে ক’জন কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সাথে গবেষণা করে যাচ্ছেন, তাদের অনেক সংগ্রাম করেই পথ চলতে হচ্ছে,। কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা নয়, এমনটা হওয়া ঠিকও নয়।
আমরা ভুলে যাই পশ্চিমা বা অন্য কোন দেশেরই আমাদের দেশের কৃষির উন্নয়নে কাজ করার কথা নয়। আমাদের দেশের কলেরা কিংবা ডেঙ্গু নিয়ে আমাদেরই গবেষণা করতে হবে। এদেশের জ্বালানী বিকল্প, নদীর গতি-প্রকৃতি, শহরায়ণের নকশা করতে হবে এদেশেরই বুদ্ধিজীবীদের। আমাদের সাহিত্য-সঙ্গীত -আইন-সংস্ক্তি-জনসংখ্যা-সমাজব্যবস্থাকে স্টাডি করে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার সাথে তুলে ধরতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই। শুধু সার্টিফিকেট প্রদানের জায়গা নয় কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়তো হতেই পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে হতে হবে সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনশীলতার সূতিকাগার। জ্ঞান বিতরণ থেকে জ্ঞান সৃষ্টির পথের যাত্রাটা সহজ নয়। আমার স্বল্প জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণের দিকে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
প্রথমতঃ আজকের নবনিযুক্ত শিক্ষকরাই ভবিষ্যতের গবেষণায় নেতৃত্ব দেবেন। তাই শিক্ষকদের গবেষণায় সর্বোচ্চ প্রশিক্ষণ প্রদান করার দায়িত্ব নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ সম্প্রতি ডক্টরাল গবেষণার জন্য ছুটি চার বছর থেকে পাঁচ বছর করার প্রশংসনীয় উদ্যোগের জন্য। একই ধরনের পদক্ষেপ প্রয়োজন পোষ্ট- ডক্টরাল গবেষনা ছুটির জন্যও। একজন শিক্ষক যখন আন্তর্জাতিক মানের কোন ফেলোশিপ অথবা এ্ওয়ার্ড লাভ করেন সেটি আন্তর্জাতিক দরবারে বাংলাদেশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই সম্মানিত করে। মাত্র দুই বছরের পোষ্ট- ডক্টরাল গবেষণায় কোন ভালো প্রজেক্টে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ অপূর্ণ থেকে যায়। আর একদল পরিণত গবেষক ছাড়া একটি প্রতিষ্টঠানের গবেষণাকে নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়তঃ প্রশিক্ষণ শেষে শিক্ষকরা যখন দেশে ফিরবেন, তখন এ প্রশিক্ষণকে কাজে লাগিয়ে নতুন প্রজেক্ট শুরুতে উৎসাহিত করতে প্রয়োজন বাজেট বরাদ্দের। প্রতিযোগিতামূলক বড় অঙ্কের বাজেট শিক্ষকদের উৎসাহিত করবে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা প্রজেক্ট তৈরিতে। একই সাথে প্রয়োজন নবনিযুক্ত শিক্ষকদেরকে বিভিন্ন অভিজ্ঞ গবেষণা দলের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়া যেতে পারে যাতে তারা কর্মজীবনের শুরু থেকেই অভিজ্ঞ গবেষকদের সান্যিধ্য লাভ করে।
তৃতীয়তঃ আমাদেরকে অনেক বড় স্বপ্ন দেখতে শিখতে হবে। এই বিশ্বায়নের যুগে কোনকিছুই নাগালের বাইরে নয়। আমাদের দেশের গবেষকরা এখনো পর্যন্ত নামমাত্র ইমপ্যাক্টের জার্নালে কিংবা predatory জার্নালে গবেষণা- প্রবন্ধ ছাপিয়ে দায়িত্ব সম্পাদন করেন শুধুমাত্র পদোন্নতির জন্য। আমাদেরকে জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় আগ্রহী করতে ছাপাকৃত প্রবন্ধের সংখ্যার পাশাপাশি প্রবন্ধের মানও বিচার করতে হবে। দেশ, দশ ও পৃথিবীর কোন কাজে না আসা শতশত প্রবন্ধের চেয়ে একটি ভালো মানের প্রবন্ধকে যদি বেশি গুরুত্ব না দেয়া হয়, তবে নিম্নমানের গবেষণার দুষ্টচক্র থেকে আমরা কখনোই বের হয়ে উন্নয়নের অংশীদার হতে পারব না। একই সাথে যে সকল শিক্ষক গবেষণাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তাদেরকে সম্মানজনক পদক, পুরস্কারের মাধ্যমে cutting edge গবেষণায় আগ্রহী করতে হবে। শিকক্ষাদান ও গবেষণা- একজন শিকক্ষকের দা্যিত্বর অংশ। স্বাভাবিকভাবেই অপারগতায় শিক্ষকদের জবাবদিহিতারও প্রয়োজন রয়েছে।
সবশেষে মনে করিয়ে দিতে চাই, সাম্প্রতিক সমস্যাসমূহের সমাধানে inter-disciplinary গবেষণার ভূমিকা ও জয়-জয়াকারের কথা। গুরুত্ব অনুসারে জাতীয় সমস্যাগুলোর তালিকা করে বিভিন্ন মেয়াদের inter-disciplinary গবেষণা দল গঠন করা প্রয়োজন বিভিন্ন বিভাগ, ফ্যাকাল্টি, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের নিয়ে। নানা বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের মাঝে collaboration, brainstorming থেকে যাত্রা শুরু করে সাফল্যের ইউরেকা মুহূর্ত পর্যন্ত গবেষণার যে দুঃসাহসিক যাত্রা, তার শুরু এবং পরিচালনার মত কেন্দ্রীয় ভুমিকা পালন করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এটা কোন অলীক কল্পণা নয়, সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও একদিন নাম লেখাবে পৃথিবীর শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায়।
শতবর্ষে এটাই আমার স্বপ্ন।
