ত্রিশে পা দেয়ার অনুভুতিটা কেমন? আজকের বাংলাদেশের নারীর জন্য? গত ক’বছরে বন্ধুদের অনেকেই ত্রিশে পা দিয়েছেন। আগামী ক’বছরে আরো অনেক বন্ধু, ছাত্রী ত্রিশে পা দিবেন। ত্রিশ আমাদের মনে কিসের ছবি নিয়ে আসে? বিশ বছর বয়সে আপনি ‘ত্রিশ এ আপনাকে’ কিভাবে দেখবেন বলে ভেবেছিলেন? কল্পনায়, মনছবিতে কেমন ছিল ত্রিশ? সেই মনছবিতে ত্রিশ এর রোল মডেল কে ছিলো?
ত্রিশ এ পা দেয়া যে নারীকে আমরা সবচেয়ে কাছে থেকে, অনেক লম্বা সময় ধরে দেখেছি, সে আমাদের মা। আমরা যখন আমাদের ত্রিশের কথা ভাবি, তখন কি অবচেতনেই আমাদের ‘মা’ চলে আসেন আমাদের সামনে? তাঁর ছাঁচেই কি নিজেদের দেখি? তার জীবন দেখেই কি ঠিক করি আমার ত্রিশ এ আমাদের জীবন কতটা ভিন্ন হবে, কতটা হবে অভিন্ন? আমাদের দু’জেনারেশনের মাঝে পার্থক্যটা মিলেনিয়ামের, পার্থক্যটা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের। আমার জীবনপদ্ধতি, সবচেয়ে বেশি সময় ও সবচেয়ে কাছে থেকে দেখা এই নারী চরিত্রের থেকে একশ আশি ডিগ্রি উল্টো। একই ব্যাপার হয়ত আপনার বেলায়ও সত্যি।
আমাদের ত্রিশে, গত প্রজন্মের ত্রিশের অনেক কিছুই নেই। আবার যুক্ত হয়েছে অভিনব সব দায়িত্ব। ত্রিশ এ এসে অনেকের ঝুলিতে যোগ হয়েছে উচ্চশিক্ষা, দিনের বড় অংশ দখলে নিয়েছে চাকরি, ঘরে-বাইরে-অনলাইনে-অফলাইনে ছুটাছুটি । এর সাথে অনেকের জীবনে যোগ হয়েছে নতুন পরিবার। তাদের কারো ঘর বদলেছে, চারপাশের জীবন বদলেছে, কারো বদলে গেছে নাম-ধাম, চিন্তা-চেতনাও। কারো যোগ হয়েছে স্কুলে ছুটোছুটি আর ফেইসবুকে Mommies গ্রুপে চিন্তাগ্রস্থ পোষ্ট দেয়া। আবার এই ‘তথাকথিত আকাঙ্ক্ষিত’ পরিবর্তন কারো কারো না হওয়াতে তারা পিঠে বয়ে চলেছেন অস্বস্তিকর ভারি এক ত্রিশ। যদি নিজের গভীরে তাকাই, তবে কি দশ বছর আগে যে জীবনের কথা ভেবেছিলাম, সে জীবন হলো না বলে আমাদের মনে অস্বস্তি খামচে ধরে? রোল মডেলের মত হতে না পারা কি আমাদের মাঝে guilt বা অনুশোচনার সৃষ্টি করে? আমাদের মাঝে নেই-নেই ভাব নিয়ে আসে? আমরা জীবনের দিকে হতাশ হয়ে তাকাই? আমরা নিজেদের failure ভাবি?
মেয়েদের বয়স বলা বারণ, আর ‘ত্রিশ’ বছর বয়স তো ভাসুরের নাম! কেনো? ত্রিশে বাঙালি নারী হয়ে যায় অপাংক্তেয়? ত্রিশে বাঙালি নারীর মৃত্যু হয়? জীবনে দাড়ি-কমা-সেমিকোলন পরে যায়? ত্রিশ হলো কিন্তু এটা-ওটা-সেটা হলো না বলে পালিয়ে বেড়াতে হয় আত্নীয়-বন্ধু-পরিচিত মহল থেকে? প্রবাসে যে কত বাংলাদেশী নারীর সাথে পরিচয় হলো, যাদের প্রবাস জীবনের মূল কারন ‘পালিয়ে বেঁচে শান্তি লাভ’। বিষয়টা কিন্তু ছেলেখেলা নয়। শিক্ষা নয়, চাকরি নয়, ট্রাফিক বা লোডশেডিংযুক্ত জীবনের জন্যও নয়। এরা প্রবাস বেছে নিয়েছেন ভালোবাসার পরিবার, সমাজকে ছেড়ে। অন্যদের আশার বোঝা এই নারীদের জন্য অনেক ভারী হয়ে উঠেছিলো। যদিও এ কারনটা লোকদেখানো নানা কারনের পেছনে অনুচ্চারিতই রাখা হয়।
ত্রিশ বছর বয়সের এত এত বদলের সাথে বদলে ফেলতে হবে জীবন দর্শনও।
আজকের বৈষম্যমূলক সমাজ ও অর্থনীতিতে কাজ করে পরিবারের অন্নসংস্থান করছেন, চৌকস খেলোয়ারের মতো ব্যক্তি জীবন, কর্ম জীবন, সামাজিক জীবন ব্যলেন্স করে যাচ্ছেন। কিন্তু এতো অর্জন-সাফল্যের পরও নিজেকে বাহবা দিতে পারছেন না! কেন! ত্রিশের যে চিত্র আমাদের অন্তরে আজন্ম বসেছিল, ত্রিশে পা দিয়ে সে চিত্রের মাঝে নিজেকে বসাতে পারি না, কেমন বেমানান লাগে। ত্রিশের কোঠার ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার/ব্যবসায়ী বান্ধবীদেরও দেখি নিজেদের ‘সবচেয়ে খারাপ মা’ হিসেবে সেফবুকে পোষ্ট দিচ্ছে। ঘরে-বাইরে সামাল দিতে না পারলেই ‘স্ত্রী’ রোল নিয়ে ভুগছে হীনমন্যতায়। কর্মক্ষেত্রে হারাচ্ছে আত্মবিশ্বাস, হারাচ্ছে নেতৃত্ব দিয়ে টিমকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষমতা। অথচ আঠারো বছর বয়সে ওরা সবচেয়ে ঝকঝকে ভবিষ্যৎ এর স্বপ্ন দেখেছিল।
এই যে ২৪ ঘন্টাই সন্তানকে দিতে না পারলে বান্ধবীরা ডিপ্রেশনের স্টেটে চলে যান, এর কারন কী? অন্যদিকে যে এখনও অনেক বাবাই দিনে ২ ঘন্টা সময় সন্তানের সাথে কাটালেই যথেষ্ট ভাবছেন, এর কারন কী? কেনো সারাবছর আপনি ঘরে-বাইরে সব সামলিয়েও নিজেকে ‘চ্যাম্প’ ভাবতে পারেন না? “কিছু তো করছি, বসে তো নেই” এই ভাবনার চেয়ে আমাদের মাথায় কেবলই কেনো বাজতে থাকে “এটা হলো না, ওটা পারি না”?
না, হরমোন এর কারণ নয়। হরমোন আমাদের নিয়ন্ত্রন করে না, আমরা হরমোনকে করি। আবেগও নয়। আবেগ আমাদের নিয়ন্ত্রন করবে না, আমরা আবেগকে করব। “আমরা” মানে আমাদের মস্তিস্ক। আমরা মানে আমাদের ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি। এটা সম্ভব, খুব সম্ভব। জীবনে শান্তি ও সন্তুষ্টির জন্য এটুকু করাই যায়। You are what you think you are. You see what you are looking to see. শুনতে চিজী মনে হলেও এগুলো গবেষণায় প্রমাণিত সত্য।
আমি নিজেকে যা ভাবি, তা ই যদি আমি হই, তবে নিজেকে নিয়ে কেন ভালোটাই ভাবি না! আমাদের positive ভাবনাই তো আমাদের কাজকে উৎসাহিত করব। আমি যদি “যা” দেখতে চাই শুধু তাই দেখি, তবে কেননা এমন কিছুই দেখি, যা আমাকে হতাশ না করে উৎসাহ দেয়?
৩০ এখানে রুপক। জীবনের যে সময়কালটাকে আমি ত্রিশ বললাম, কারো জীবনে তা হয়ত ২৫, ৩৫ কিংবা ৪০। ত্রিশ এর অর্থ যাই হোক, আপনি যদি আপনার ত্রিশ এ খুশী না থাকেন, তবে এর সংজ্ঞা/মনছবি বদলে ফেলুন। ত্রিশ এর অর্থ হোক আনন্দ, maturity. ত্রিশ এর অর্থ হোক জীবনকে আরো পরিষ্কারভাবে দেখতে পাওয়া। ত্রিশ হোক চ্যালেঞ্জ নেয়ার সময়, জীবনের fulfillment এর সময়। কারন ত্রিশ এ আপনিই আপনাকে drive করতে পারবেন। দায়িত্ব যত বেশি, চ্যালেঞ্জ তত বেশি। জীবনের অর্থ আর আনন্দও ততটাই বেশি! কুড়ি বা ত্রিশ, কোন বয়সেই আপনি বুড়িয়ে যান না, যতক্ষণ আপনার মনটা সজীব থাকে।
ত্রিশের নারী হোক নিজেকে ভালোবাসা ও আত্মবিশ্বাসে ভরা এক শক্তি।
জয়তু “৩০”!
