Skip to content

প্রত্যাবর্তণ

অনন্তের পথে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছি। চাঁপার ঘ্রাণ পাচ্ছি। অথচ চাঁপার ঘ্রাণ আমার জানা নেই। গাছগাছালিতে নয়, ইট-পাথরে বেড়েছিলাম। চাঁপা তাই বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা শব্দমাত্র। এই ঘ্রাণ কি আমার কল্পনার? মৃত্যুর সময় কি এমনই বোধ হয়? পৃথিবী শেষবারের মত চেষ্টা করে মায়ায় বেঁধে রাখতে? আচ্ছা, সবাই কি চাঁপার ঘ্রাণ পায়? মৃত্যুতো কুৎসিত হয় বলে জানতাম! ভয়ংকর-দর্শণ কেউ এসে সামনে দাঁড়াবে তীব্র যন্ত্রণা দিতে। মুহুর্তেই সব অন্ধকার। তবে আমি কেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি এত রাশি রাশি আলোর ফুলকি?এ ফুলকিদের চিনি। এরা সুন্দর, কিন্তু মিথ্যে।

হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকেই আমার চোখে সমস্যা ছিল। রোল নম্বর অনুযায়ী প্রতিদিন আসন পরিবর্তন হত। আগের দিনের সীটের পেছনেরটায় বসতে হতো। কয়েক আসন পেছনে গেলেই আর ভালো দেখতে পেতাম না। ভেবেছিলাম সবাই বুঝি এমনি ঝাপসা দেখে। ইংরেজির টিচার মিস্টার গঞ্জালভেস একদিন বোর্ডে লেখা কোন একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলেন। “দেখতে পাচ্ছিনা”, মিনমিন করে বললাম। উনি ভাবলেন, আমি ফাঁকি দিচ্ছি। দুটো কথা বলে হালকা অপমান করলেন। কয়েকজন ছেলেমেয়ে হি হি করে হাসলো। ক্লাসের পর, গাছের আড়ালে বসে খুব কাঁদলাম আমি।

কৈশোরে খুব দুর্বল ছিলাম। তখন থেকেই একটু দূরের কোন আলো দেখতে পেতাম না। আসল আলোর চারপাশজুড়ে অসংখ্যা মিটমিটে আলো দেখতাম। কি অদ্ভুত, কি অদ্ভুত! মৃত্যুর আগে আগে দেখা দিল ফুলের সুবাস, আলোর নাচন, তবুও আমি ফিরে যাচ্ছি কৈশোরের এক বিচ্ছিরি ঘটনায়! হতাশাবাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করো তোমরা আমায়, আমি এক দূষণ, আমায় যেতেই হবে।অনেক বদলে গিয়েছিলাম যৌবনে এসে। আরো বেশি পাল্টে গেলাম পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে। তারপর আরও কতবার বদলেছি! এ যেন আমি নই, প্রতিটি পর্বে ভিন্ন ভিন্ন একেক ‘কামিনী’। প্যানপ্যানে কিশোরী কামিনীর মৃত্যু ঘটেছিল হাঁ করে পৃথিবী গেলা যুবতী কামিনীর জন্ম দিয়ে।

যুবতী কামিনী মরে গিয়েছিল বছর দশেক বাদে, সব কিছুর প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে। কামিনীরা একই মানুষ, একই শরীর। অথচ কেউ কারো বন্ধু হতে পারত না। নিজেকে কখনো ভালবাসতে পারিনি। অথচ খুব করে চাইতাম আর-সবাই আমায় ভাল পাক। কেউ কেউ ভাল বেসেও ছিল। কিন্তু সব ভালোবাসাতেই ছিল শর্ত প্রযোজ্য। ভালোবাসা ততক্ষণ, যতক্ষণ আমি অবনত। একজন বিনীতা সমাজকে মাথা পেতে নেয়, বিনা বাক্য ব্যয়ে। সব ভালোবাসা তাই মন খুলে গ্রহণ করতে পারিনি সবসময়। যে ভালবাসা ডানা ভাঙ্গতে চায়, সে দখলদারী ভালোবাসাকে ভয় হয়। বারান্দার শিকে কপাল ঠেকিয়ে যুবতী কামিনী প্রায়ই চেয়ে থাকতো নিকষ আঁধারের দিকে। দৃষ্টিহীণ হওয়ার চেয়ে আঁধার দেখা ভালো। কোন খারাপই আসলে সবচেয়ে খারাপ নয়। লোকে ঠিক দেখিয়ে দেবে এর চেয়ে খারাপ কিছুও হতে পারতো। আসলেই তাই।

যৌবনে আমার বারান্দা থেকে আমি দেখতে পেতাম একটি পিজ্জা আর একটা মদের দোকান। দুটোই সস্তা। আমি কাজ শেষে বাড়ি ফিরে বারান্দায় বসতাম। দোকানের খদ্দেররা উচ্চস্বরে হাসতো, কার্ড খেলত গভীর রাত পর্যন্ত। আর হেঁড়ে গলায় হেঁকে উঠতো উচ্ছাসভরা গান। ওদেরকে আমার খুব সুখী মনে হতো। ওই কোলাহলে আমি সময় ভুলে যেতাম। ঘাড় বাঁকিয়ে রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়া মানুষদের দিকে চেয়ে থাকতাম। ওই লোকটা বোধহয় আজ শেষ ট্রেনটা মিস করবে! ওই সুসজ্জিতা আজ পার্টিতে খুব মন খুলে নাচবে! রাত বাড়তো, ক্ষুধা লাগত। ডিনার শেষে আলো নিভিয়ে মেঝেতে পাতা ম্যাট্রেসে শুয়ে পরতাম। খোলা বারান্দা দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় ছাদের এক চিলতে আলো হয়ে উঠতো। আমি ওই আলোর দিকে তাকিয়ে থেকেছি। দিন-মাস-বছর-যুগ।বারান্দাই আমার ঘর হয়ে উঠল। বারান্দায় আড়াল তুলে দিলাম অর্কিডের ঝোঁপ দিয়ে। পাতার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতাম। দেখতাম। কাক, পাতা, বৃষ্টি, মালী, বালিকা। এ বারান্দা থেকে অনেক ছবি তুলেছি। কোন ছবিতেই ঠিক দেখার মত কিছু নেই। কেউ কখনো দেখেওনি এই ছবিগুলো। দেখলে নিশ্চিত জানতে চাইত, “ও কিসের ছবি তুললে বলত! কিছুই তো নেই!” আমি মনে মনে বলতাম, “শুন্যতার ছবি। লোভী মন। শুন্যতাও হারিয়ে দিতে মন চায় না”।

এক রাতে তুমুল বৃষ্টি দেখলাম। পরদিন আমার কাঁপিয়ে জ্বর আসলো। ভালোবাসার মানুষটি চেহারাটা অমাবস্যার চাঁদ বানিয়ে রেখে দিন রাত মাথায় জল ঢালতে লাগলো। অচেতনে কেবল শুনতে পেলাম নদীর শব্দ, ঝর্ণার শব্দ। মাঝে সাঝে চোখ খুলে বললাম, “খুব অফিস কামাই হচ্ছে, না?”জোর করে ও ঠোঁট দুটো নাড়ত। ওটার নাম কাষ্ঠহাসি। ঠিক জানি, আমি মরলে ও রাতের পর রাত কাটিয়ে দেবে ওই বারান্দায়। এত ভাবনা কেন উড়ে আসছে চেতনা জুড়ে? মরতে ভয় পাচ্ছি? কয়েক মুহূর্ত জীবন বাড়িয়ে জীবনের কী অর্জন? অনেক নিচে সাদা তুষার। আজ চারপাশ কি ধবধবে! তারা ভর্তি আকাশ আর পাতা-ডালে জমে থাকা শুভ্র স্ফটিক। গভীর রাত। পৃথিবীর এই প্রান্তের জীবিতদের জন্য এখন বিশ্রামের সময়, স্বপ্নে ডোবার সময়। কত বছর হলো, আমি চোখ বন্ধ করি আর দুঃস্বপ্ন থেকে টেনে তুলি নিজেকে মাঝরাতে।

হাতটা একটু একটু কাঁপছে। চাঁপার গন্ধটা বেশ তীব্র। এত ভয় লাগছে যে, কাঁপা হাতটা কিছুতেই ছাড়াতে পারছি না কলাম থেকে। তালুটা ঘামে ভিজে একাকার, পিছলে পিছলে যাচ্ছে, তবু আঙুলগুলো কলামটাকে আঁকড়ে ধরছে আরো শক্ত করে। কাঁপুনিটা ছড়িয়ে পরছে সারা শরীরে। বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে, দ্রাম, দ্রাম, দ্রাম। পা-জোড়াও এখন ঠকঠকে।কারো খোলা জানালা দিয়ে ভেসে আসলো অতিপরিচিত সুর।

“চন্দনা গো, রাগ করো না,

অভিমান করে বলো আর কি হবে?

চন্দনাগো, সময় চলে যায়,

মন শুধু জ্বলে যায়,

তৃষ্ণার জল নিয়ে এসো না তবে”

তেষ্টা পেয়েছে। এত ভুগলাম, এত বদলালাম, এত শিখলাম। এইভাবে শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য? অভিমান করে চন্দনা যেখানে খুশি যাক, কিন্তু কামিনী থাকবে, কামিনী বাঁচবে। অবিশ্বাসে, প্রতারণায়, কিংবা ভালোবাসার গায়ের গন্ধে, যা কিছু আসুক, কামিনী বাঁচবে। মরবে তো সবাই। কিন্তু মৃত্যুর আগে কামিনী মরবে না আর। ঠকঠক করে কাঁপতে থাকা ঘামে ভেজা শরীরটাকে নামিয়ে আনতে হবে রেলিংয়ের উপর থেকে। তারপর এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে বারান্দার দরজাটা আটকাতে হবে। বারান্দা-প্রেম আপাতত চাপা পরুক জীবন-প্রেমের কাছে। ঘামটা আরও বেড়েছে। হাত-পায়ের তালু পিচ্ছিল অথচ মুখের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ।

অন্তরমহলেই এত দ্বন্দ্ব কেন! মরতে চেয়েছিলাম, ভয় লাগেনি। বাঁচবো ভাবলাম, পৃথিবী পিঠ দেখাচ্ছে! হাতে আঁকড়ে রাখা কলামটাকে ধরে ঘুরে দাঁড়াতে হবে ঘরের দিকে, তারপর রেলিং থেকে বারান্দার মেঝেতে আস্তে করে লাফ। এটুকুই তো। চাঁপার গন্ধটা দুঃসহ রকম তীব্র। শ্বাস জোর করে বন্ধ করে রেখেছি। প্লেয়ারের গানটা বদলে গিয়ে বাজছে পৃথিবী কাঁপানো সুরে, ‘কামিনী গো, সময় চলে যায়, মন শুধু জ্বলে যায়’। “স্টপ ইট, লিভ মি এলোন, স্টপ ইট, স্টপ ইট, স্টপ ইট”, প্রচন্ড ক্রোধে চিৎকার করে উঠলাম সমস্ত শরীর ঝাঁকিয়ে। তাল সামলাতে পারলাম না। সামনে সাদা কুয়াশা, আলোর ফুলকিরা নিয়েছে বিদায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *