Skip to content

প্রথম ফ্যাক্টরঃ ‘ব্যাড প্যারেন্টিং’

দোতলার সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে এক ছাত্র আমাকে লিখার জন্য অনুরোধ করল। আমি সিঁড়ি পেড়িয়ে নিজের অফিসে যেতে যেতে ভাবলাম, কী লিখবো! আমি লেখক নই। কোনো একদিন কোথাও লিখেছিলাম, সে থেকে প্রতিবছর এই স্যুভেনিরে লেখার অনুরোধ আসে, আমিও স্যুভেনিরের পাতা ভর্তির কথা চিন্তা করে লিখে দেই। কিন্তু এর তো শেষ আছে, আমি তো লেখক নই। অলেখকরা যখন লেখে, তখন নিজের গল্পের বাইরে যেতে পারে না। জল্পনাতেও নিজের জীবন কি বন্ধুর অভিজ্ঞতা। ডানে তাকাই, বাঁয়ে তাকাই। বাংলাদেশীদের জীবনে যত না ঘটনা, ততোধিক দুর্ঘটনা। পথে ঘাটে অগণিত আগ্রাসি মানুষ, সীমিত সম্পদ নিয়ে কাড়াকাড়ি।

চারপাশে এই যে এত মানসিক বিকারগ্রস্ত বাঙালিরা, তাদের বিকারের শুরুটা কোথায়? আমার মতে জন্ম থেকেই আসলে আমাদের বিকারের শুরু, প্রথম ফ্যাক্টরঃ ‘ব্যাড প্যারেন্টিং’। তাহলে আমাদের বাবা মায়েদের কি আমি বলছি ‘খারাপ বাবা-মা’? বাবা-মা কখনো খারাপ হয় না, এই অতি ভালমানুষি তত্ত্বের সাথে আমি একমত হতে পারিনা। সন্তান বিক্রি করা, আটকে রাখা, এমনকি ধর্ষণ, অনুসন্ধান এ এমন তথ্য অপ্রতুল নয়। তবে ব্যাড প্যারেন্টিং ব্যাপারটা আলাদা। বাবা-মা ভীষণ ভালোমানুষ হয়েও সন্তানকে সুস্থভাবে গড়ে তুলতে অসফল হতে পারেন অসচেতন প্যারেন্টিং এর কারনে। সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য নারী পুরুষ প্যারেন্টিং বোঝার আগেই প্যারেন্ট হয়ে যান। 0 থেকে 7 বছর বয়স পর্যন্ত সময়টাতেই নির্ধারিত হয়ে যায় আমাদের বাকি জীবনের গল্প, আর এসময়ের গল্পের প্লট যদি অগোছালো হয়ে যায়, তবে এই জীবনের গল্পটা পাল্টানো কঠিন হয়ে যায়। দুর্নীতি ও সামাজিক অপরাধের আধিক্যই বলে দেয়, বাঙালির জীবনের প্রথম 7 বছর কতটা অশিক্ষায় কাটে। জীবনের যে রসদ নিয়ে আমরা চলছি, তার সঞ্চয় হয়েছিল প্রথম সাত বছরে, মায়ের গর্ভধারণের মুহূর্ত থেকে শুরু করে। আমরা বুঝতে পারিনা, কিন্তু একজন শিশু প্রতিমুহূর্তে শিখছে এবং স্মৃতির পাতায়, অবচেতনে সঞ্চয় করছে অনেক কিছু। এই অবচেতনের শিক্ষা আমাদের নানাভাবে প্রভাবিত করে। একটি হাসিখুশি, ভয়শূন্য, সৃষ্টিশীল শৈশব তাই সফল জীবনের চাবি। শৈশবে যে গল্পের প্লট লেখা হয়ে যায়, কৈশোরে সে গল্পে আরো ডিটেইল যোগ হয়ে গল্পকে পোক্ত করে। অবচেতনে লেখা এই গল্পকে বলে স্ক্রিপ্ট (script)। পৃথিবী সম্পর্কে যখনো আমাদের মস্তিষ্ক সচেতনভাবে খুব বেশি তথ্য সংগ্রহ করে উঠেনি, অথবা সয়ে উঠিনি রূঢ় বাস্তবতার আঘাত, তারও আগেই রচিত হয়ে গেছে আমাদের ভবিষ্যৎ, এমনকি জীবনের শেষটা কেমন হবে সেটাও। শৈশবে আপনার চারপাশে থাকা মানুষগুলো, তাদের ব্যবহার ও ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ইতিমধ্যে নির্ধারণ করে ফেলেছে আপনি জীবনকে কিভাবে দেখবেন ও নানান প্রেক্ষাপটে আপনার অবস্থান ও একশন কেমন হবে।

বিষয়টা অন্যায্য মনে হতে পারে। যে সময়টায় আপনি ছিলেন অসচেতন ও বাবা মায়ের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল, যে সময়টাই আপনার ব্যক্তিত্ব নির্ধারণ করলে আপনার বাকি জীবনে আপনি তবে কিভাবে নিজেকে গড়ে তুলবেন! কিন্তু সত্য হচ্ছে এই যে আপনি কোন রঙের চশমা দিয়ে জগৎ দেখবেন অর্থাৎ আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে, সেটা নির্ধারিত হয় আপনার শৈশবে।এই যেমন একটি বুলেট আপনার হাতে জখম করলে আপনি নিজেকে হতভাগা ভাবতে পারেন। কেনো এত অসংখ্য মানুষের মাঝে আপনিই আহত হলেন, ভেবে ভেবে হতাশ হতে পারেন, কাজে স্পৃহা হারাতে পারেন, এভাবে বিষন্ন জীবন কাটাতে পারেন। অথচ আপনি জীবনটাকে আরো উপভোগ্য করতে পারতেন, যদি অনুধাবন করতেন যে বুলেটটি বুকে বা মাথায় ও লাগতে পারতো, আপনি না ও বেঁচে থাকতে পারতেন। আপনি বরং দ্বিতীয় জীবন পেয়েছেন। এই ভাবনা থেকে আপনার জীবন আরো কর্মময় ও আনন্দঘন হতে পারে। জীবনকে দেখার অসংখ্য চশমা থেকে একটি চশমা আমরা অবচেতনে শৈশবেই বেছে নিই।

একটি সুখবর হচ্ছে যে বয়স্ক হবার পর যদি আপনি অনুভব করেন যে আপনার স্ক্রিপ্ট আপনাকে সুস্থ জীবনযাপনে সহায়তা করছে না, তবে সচেতনভাবে আপনি স্ক্রিপ্ট পরিবর্তন এর চেষ্টা করতে পারবেন এবং এই পরিবর্তন বেশ ভালভাবেই সম্ভব। অর্থাৎ কোন চশমা দিয়ে আপনি পৃথিবীকে গ্রহণ করবেন, সেটা আপনি কিছু অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে আপনিই ঠিক করতে পারবেন। অভ্যাসগুলো রপ্ত করার জন্য আছে অনেক তত্ত্ব, ট্রেইনিং এবং বই। তার মধ্যে “TA Today, A New Introduction To Transactional Analysis by Ian Stewart and Vann Joines” বইটির কথা না বললেই নয়। Transactional Analysis হচ্ছে একটি theory of personality. ছোট্ট এ লেখাটিতে আমি এ বই থেকে নেয়া কেবল দু একটি টিপস উল্লেখ করছি।

প্রথমতঃ, যে কোন পরিস্থিতিতে আপনি “here and now” এ থেকে একশন নিতে পারেন। এর অর্থ হচ্ছে কোনো একটি মুহূর্তে আপনি আপনার চারপাশে ঘটা ঘটনাবলির সাপেক্ষে এবং available সকল resource ব্যবহার করে আপনার চিন্তা, অনুভুতি, ও ব্যবহারের মাঝে সামঞ্জস্য রেখে চলবেন। দ্বিতীয়তঃ আপনার চারপাশের মানুষদের, হোক সে বন্ধু, আত্মীয়, বা সহকর্মি; তাদের ছোট ছোট ভাল কাজ, প্রচেষ্টা, বা অর্জনের স্বীকৃতি দান করুন। আপনার চারপাশে সাবলীল ও পজিটিভ আবহ তৈরি হবে এবং আপনার দেয়া স্বীকৃতি, প্রশংসা হয়ে আপনার কাছেই ফেরত আসবে। এবং পরিশেষে আপনার সময়কে সঠিক কাজে ব্যয় করুন। ছয় ধরনের কাজে আমরা সময় ব্যয় করে থাকি, তার মাঝে তিনটি কাজ এখানে উল্লেখ করছি। আপনার চারপাশ থেকে কিছু সময় অন্তত নিজেকে আলাদা করে রাখুন। একে বলে withdrawal. এ সময়টা ভাবনা-চিন্তা, মেডিটেশন ইত্যাদি কাজে ব্যয় করুন। বাকি সময়টুকু ব্যয় করুন intimacy ও activities এ। আপনার কাছের মানুষদের সাথে সৎ ও আন্তরিক সময় অতিবাহিত করুন (intimacy), আপনার অকপট অনুভুতিগুলো প্রকাশ করুন। সেই সাথে activities অর্থাৎ goal-oriented কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।

ল্যাব এক্সপেরিমেন্ট কিংবা রান্নার মতোই সুস্থ-সফল জীবনও রেসিপি অনুসরণ করে অর্জন করা যায়। প্রয়োজন শুধু অভ্যাস। জীবন গঠনের সাতটি অভ্যাস সম্পর্কে জানতে পড়ুন Stephen R Covey লেখা The 7 Habits of Highly Effective People। বাংলায় বইটির ভাবানুসরণ পাবেন ডঃ কালীপ্রসন্ন দাস এর লেখা ‘জীবন গঠনে সাত অভ্যাস’ বই এ। আরো আছে Sean Covey র লেখা The 7 Habits of Happy Kids, and The 7 Habits of Highly Effective Teens.

আপনার স্ক্রিপ্ট পাল্টে ‘আপনার আপনি’ তৈরির প্রচেষ্টায় আপনাকে অভিনন্দন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *