একজন শিশু কতক্ষণ সময় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কাটাচ্ছে, সেটাকে আমি বলছি স্ক্রিন টাইম। স্ক্রিন টাইমের মাঝে অন্তর্ভুক্ত থাকবে টেলিভিশন দেখার সময়, শিশুটি যে সময়টুকু মোবাইল ডিভাইস নিয়ে খেলছে এবং অন্য যে কোন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের স্ক্রিনে চোখ রাখছে ইত্যাদি।
শিশুর স্বাস্থ্যে স্ক্রিন টাইমের প্রভাব শুধুমাত্র সময়ের দৈর্ঘ্যের উপরেই নির্ভর করে না। পাশাপাশি স্ক্রিনে কি ধরনের কনটেন্ট শিশুটি দেখছে, অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পরে কতক্ষন শিশু স্ক্রিন ব্যবহার করছে, কি ধরনের ডিভাইস ব্যবহার করছে এবং কতটি ভিন্ন ভিন্ন ডিভাইস একজন শিশু ব্যবহার করছে, এই সবকিছু মিলেই শিশুর স্বাস্থ্যের উপর স্ক্রীনের প্রভাব আলোচনা করব।
একজন শিশু যদি অতিরিক্ত সময় স্ক্রিনে কাটায় তবে তার ঘুমের সমস্যা, হৃদযন্ত্রএর সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, কোলেস্টেরলের সমস্যা ইত্যাদি নানা অসুখ নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা কমে যায়। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স এর সমস্যা হতে পারে। এছাড়া আরও যেসব স্বাস্থ্য সমস্যা অতিরিক্ত সময় স্ক্রিনে কাটানোর জন্য হয় তার মাঝে রয়েছে চোখের সমস্যা, শরীরের হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া, সর্বোপরি শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি।
নিচের কয়েকটি বিষয়ের উপর স্ক্রিন টাইম এর প্রভাব নিয়ে আজ আলোচনা করব এবং পড়ার সুবিধার্থে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা আলাদা-আলাদাভাবে পোষ্ট করছি।
১) ঘুম
২) ডায়েট ও স্থূলতা
৩) ব্লাড প্রেসার ও কোলেস্টেরল
৪) স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ
৫) দৃষ্টিশক্তি
৬) আসক্তিমূলক আচরণ
৭) ডিপ্রেশন, আত্মহত্যার প্রবণতা, ও মনোযোগের অভাব
শিশু এবং যে কারো ঘুমে স্ক্রিনটাইমের প্রভাব
ডিজিটাল মিডিয়ার সাথে ঘুমের সম্পর্ক দ্বিমুখী। ডিজিটাল মিডিয়ার ব্যবহার শিশু-কিশোরদের ঘুমের সময় এবং গভীরতা/মান, দুটোকেই ক্ষতিগ্রস্থ করে। ৪-৮ বছর বয়সী শিশুদের উপর গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুমের এই স্বল্পতা থেকে পরের দিন শিশু ক্লান্ত বোধ করে, ক্লান্ত শিশু খেলাধুলা, দৌড়াদৌড়িতে আগ্রহ হারিয়ে সেডেনটারি (দিনের বেশির ভাগ সময় বসে থাকতে অভ্যস্ত) জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়। আবার সেই সেডেনটারি আচরণ শিশুদের ঠেলে দেয় আরো বেশি স্ক্রিন টাইমের দিকে। স্ক্রিন টাইম ছাড়াও, শুধু শারিরীক কাজের অভাব বা সেডেনটারি আচরণও শিশুর (এবং যে কারো) ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস থেকে নিঃসৃত উজ্জ্বল-নীল আলো শরীরে মেলাটোনিন নামের হরমোন তৈরিতে বাঁধা দেয়। আলো ছাড়াও একই ব্যাপার ঘটে ডিভাইসের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক র্যাডিয়েশন থেকেও। অথচ অন্ধকার হওয়ার পর শরীর থেকে মেলাটোনিনের নিঃসরণ আমাদের শরীর-মনকে শান্ত করে আমাদের ঘুম পারায় ও দিন-রাত্রির চক্র ঠিক রাখে। ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহার তাই আমাদের ঘুম ও কাজের চক্রকে নষ্ট করে দেয়। অপর্যাপ্ত ঘুম থেকে শিশুদের অস্থিরতা, মনোযোগের অভাব, বদমেজাজ ও খিটখিটে আচরণ দেখা দেয়। ঘুমের সময় হাতের কাছে কিংবা শোবার ঘরে ডিজিটাল ডিভাইসের উপস্থিতি বাড়তি স্ক্রীনটাইমের ঝুঁকি বাড়ায়, সব বয়সের মানুষের জন্যই।
রাতের ঘুমের পাশাপাশি, দিনে টিভি দেখা বাচ্চাদের দিবাকালীন ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় প্রভাবিত করে। পরোক্ষভাবে টিভি দেখাও শিশুর স্বাস্থ্যঝুকি তৈরি করে। শিশু যখন নিজে সক্রিয়ভাবে টিভি দেখছে না কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ডে টিভি চলছে, হয়ত পরিবারের অন্য সদস্যরা কিছু দেখছে; ৫-৬ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে সেটাও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।
স্ক্রীনটাইমের পাশাপাশি স্ক্রিনের কন্টেন্ট (অর্থাৎ শিশু স্ক্রিনে কী দেখছে) সেটার সাথেও ঘুমের যোগ রয়েছে। আসলে শুধু ঘুম নয়, একটু পরের আলোচনায় দেখব যে শিশুর সার্বিক ও সামগ্রিক শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে কিভাবে কন্টেন্ট বা স্ক্রিনের বিষয়বস্তু প্রভাবিত করতে পারে। দিনের বেলা ১২ মিনিটের অথবা রাতের বেলা ১৫ মিনিটের ভায়োলেন্ট কন্টেন্ট ৩-৫ বছর বয়সী শিশুদের অপর্যাপ্ত ঘুমের ঝুঁকি বাড়ায়। সোশ্যাল মিডিয়া, উত্তেজক ভিডিও গেইমস, দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করে এমন খবর/নোটিফিকেশন এ সবই মনো-শারীরিক উত্তেজনার সৃষ্টি করে শিশু-কিশোরদের দিন-রাতের চক্র নষ্ট করতে পারে।
