Skip to content

The Black Magic of Busyness (ব্যস্ততার কালো জাদু)

আপনি জানেন কি, একজন আমেরিকান অধিবাসীর জীবনে গড়ে ৭০০০ ঘন্টা (৬ মাস) চলে যায় বিভিন্ন সেবার জন্য লাইনে অপেক্ষা করে। বাংলাদেশিদের জন্য সংখ্যাটা যে এর চেয়ে ঢের বেশি, তা বোঝার জন্য আলাদা করে পরিসংখ্যানের দরকার হয়না। দিনের প্রায় অর্ধেক সময়ই আমাদের ট্রাফিক আর নানা লাইনে অপেক্ষায় পার হয়ে যায়।

ইঞ্জিনিয়ার ডনের কাছে এটাকে সময়ের বিশাল অপচয় বলেই মনে হয়েছিল। তিনিই প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন ব্যাংকে টাকা তোলার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে না দাঁড়িয়ে automated teller machine বা ATM ব্যবহারের কথা।আর এখন, শুধু ATM ই নয়, প্রতিদিন সময় বাঁচাতে আমরা আরো কত স্বয়ংক্রীয় যন্ত্রের প্রতি ঝুঁকছি! আমাদের ব্যস্ত জীবন থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা সাশ্রয় হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বিনিময়ে আমরা কি কিছু হারাচ্ছি? আমরা কি সত্যিই সময় স্বল্পতায় ভুগছি? আমরা কি আদতেই এত ব্যস্ত?

গবেষণায় উঠে এসেছে, যারা নিজেদের বেশি ব্যস্ত মনে করে, তাদের মাঝেই ডিপ্রেশনের হার বেশি। শুধু তাই নয়, আমরা নিজেদের যত ব্যস্ত ভাবি, বাস্তবে আমরা ততটা ব্যস্ত নই। এই ব্যস্ততার উপলব্ধিতা অধিকাংশই আমাদের মাথায়। লেখক লোৱা ভানডারকান একদল মানুষের ১০০১ দিনের রুটিন এনালাইসিস করে এই উপসংহারে আসেন। এমন অনেকের রুটিন জানি, যাদের হয়ত সেদিনের কাজ বলতে শপিং করা, বা ওই সপ্তাহের কাজের লিস্টে রয়েছে টুকিটাকি কিছু কাজ। কিন্তু তাদের ভাবনাটা এমন যেন এত ব্যস্ত রুটিনের মাঝে কি করে কি করা যায়! ব্যস্ততার এই ভান আমরা জেনে বা না জেনে অসচেতনভাবে করে থাকি। কিন্তু কেন? কারণ আমরা ভাবি, ব্যস্ততা সফলতার সমানুপাতিক। তাই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে আমরা নিজেদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ব্যস্ত হিসেবে প্রেজেন্ট করি এবং তাই বিশ্বাস করি। আসলে কিন্তু ব্যস্ততার সাথে সাফল্যের কোনো যোগ নেই, সুখের তো নয়ই!

উন্নত দেশগুলোতে সেবাদানে স্বয়ংক্রিয়তা যত বেড়েছে, মানুষের একাকীত্ব ততটাই বেড়েছে। মানুষও যেন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র হয়ে গেছে। ১৯৮০ সালের তুলনায় বর্তমানে একাকীত্বের হার দ্বিগুন হয়েছে।  আর এই একাকীত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে নানান শারীরিক ও মানসিক অসুখ-বিসুখের মাধ্যমে।

আরেকটি গবেষনার কথা বলি। ওই গবেষণায়, হ্যাপিনেস স্কেল (আগের একটি লেখায়  হ্যাপিনেস স্কেলের ব্যাখ্যা আছে) অনুযায়ী সুখি মানুষদের নিয়ে একটি জরিপ করা হয়েছিলো। তাদের জীবনধারায় যেটা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল, তা ধর্ম বা মেডিটেশনের মত আধ্যাত্নিক কিছু নয়; কিংবা ব্যায়াম বা ভোরে ওঠার মতো সুস্থ জীবন চর্চা নয়; বরং তাদের জীবনে সবচেয়ে প্রাধান্য পেয়েছিল social interaction। আরো কিছু গবেষণায়ও উঠে এসেছে, যে activity টি আমাদের সবচেয়ে বেশি ভাল অনুভূতি বা উদ্দীপনা দেয়, তা হচ্ছে socialization। কারো সাথে এই যে দুটো কথা বলে হালকা হওয়া, সেটা এই  এমনকি সেটা অপরিচিত কারো সাথে হলেও।

আজ থেকে অর্ধশত বছর আগের কথা। পছন্দের একটি গান শুনতে চাইলে বা মুভি দেখতে চাইলে মানুষকে একটি লাইব্রেরি বা রেকর্ডের দোকানে যেতে হতো। লাইব্রেরিয়ান বা বিক্রেতার সাথে আলাপচারিতা ছিল সামাজিকতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। আবার লাইব্রেরিয়ান পর্যন্ত যাওয়ার আগে চলত পাড়া-প্রতিবেশি আর বন্ধুমহলে খোঁজ। এখন প্রায় সব কেনাকাটা হওয়া সম্ভব মাউসের ক্লিকে। এ যেন যতভাবে সম্ভব, আমরা একে অপরকে এড়িয়ে চলছি সময় বাঁচাতে। তারপর সেই বাঁচানো সময় ঠিক কি এমন হাতি ঘোড়া কাজে লাগাচ্ছি? একলা বোধ করতে?

ATM আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসতে পারে না, কিন্তু একজন ব্যাঙ্কার তা পারেন। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক ভদ্রলোক/মহিলার সাথে আপনার মাত্র দু’বাক্যের ভাবের আদান-প্রদানও আপনার ব্রেনকে উদ্দীপিত করে। অনলাইনে অসংখ্য বন্ধুর সাথে বার্তা আদান-প্রদানে একাকীত্ব কাটলেও সেখানে চোখের চাউনি, কন্ঠস্বরের উত্থান-পতন, মুখের ভাবের কোন আদান-প্রদান হয়না। সহানুভূতির সাথে কেউ আপনার মাথায় হাত রাখে না, আঙ্গুল ছুঁয়ে দেয় না। মনের প্রলাপে প্রলেপ দিতে সামনাসামনি যোগাযোগ বা physical interaction এর বিকল্প নেই। তাই টেকনোলোজির ব্যবহারের সাথে সাথে নির্বিচারে সব ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয়তা ব্যবহারের ঝুকি সম্পর্কেও সতর্ক থাকতে হবে।

আনন্দময় জীবনের পেছনের খেলোয়াড়দের খুঁজতে হয়েছে অনেক গবেষনা। আর তাতে উঠে এসেছে চমকপ্রদ অনেক তথ্য। এই যেমন, সুখি হওয়ার জন্য আনন্দের গভীরতার চেয়ে আনন্দের ঘন ঘন পুনরাবৃত্তি বেশি কার্যকর।

আহা কি আনন্দ, আকাশে, বাতাসে

শাঁখে শাঁখে পাখি ডাকে

কত সুধা চারিপাশে

আসলেই তাই। ভোরের সূর্য্য দেখে হাসুন, পাতার মর্মর শুনে হাসুন, ল্যাম্পপোস্টের ছায়া দেখে হাসুন, চাঁদের বুড়িকে দেখে হাসুন। চারপাশে নিত্য সুধা, সে সুধা গ্রহনে কার্পণ্য কিসের! সারাদিন ধরে ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্তগুলো আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের সহায়ক। সপ্তাহের বা মাসের কোন একটা দিন খুব জম্পেশ আনন্দের প্ল্যান করছেন বলে বাকি সব দিনের আনন্দ বিসর্জন দিতে হবে, তা তো নয়।

একটা সময় ধারনা করা হতো introvert বা অন্তর্মুখী মানুষেরাই চারপাশের মিথস্ক্রিয়া এড়িয়ে চলতে চান। এই ধারনার অসাড়তা প্রমানিত হয়েছে অনেক গবেষনায়। বাস-ট্রেনের মত যোগাযোগের মাধ্যম বা অপেক্ষাগারের যাত্রীদের নিয়ে করা স্টাডিতে দেখা গেছে, পার্সোনালিটি টাইপ যাই হোক না কেন, চুপচাপ বসে না থেকে সহযাত্রীর সাথে গল্প করা যাত্রীদের ভ্রমণ বেশি আনন্দদায়ক হয়। এই স্বল্পকালীন আলাপের গুরুত্ব হেলায় উড়িয়ে দেয়ার নয়।

আমরা অন্যের মতামত যত কম শুনি, তাকে তত কম জানি।

আমাদের সহ্যশক্তি তত কমে আসে, জন্ম নেয় বৈরিতা, পরশ্রীকাতরতা।

যেকোন থিওরিই ব্যবহার করতে হয় কনটেক্স না, জায়গা বুঝে। ঢাকা শহরের মতো জায়গায় অপরিচিত কারো দিকে হাসিমুখে তাকানো বা দুটো ভালোমন্দ জানতে চাওয়া ক্ষেত্রবিশেষে হিতে বিপরীতও হতে পারে। কিন্তু পরিচিত আবহে, এই যেমন পাড়ায়, অফিসে, বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এটা ঝুঁকির কিছু নয়। বরং আপনি সোশ্যাল ও ইজিগোয়িং হিসেবে পরিচিতি পাবেন।  আর পরিচয়েই প্রসার!

তাহলে মোদ্দাকথা কী দাঁড়ালো?

প্রতিদিনকার জীবনে সামাজিক যোগাযোগ আরো বাড়ানো। ‘আর বলবেন না!’ বলে শুরু করা মোটে এক মিনিটের আলাপ-সালাপও আপনাকে কয়েক ঘণ্টার উদ্দীপনা দিতে পারে।

প্রথম প্রকাশঃ ৫ ডিসেম্বর ২০১৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *